বাইডেন যদি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে না লড়েন, তাহলে কী হবে?
আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন। আগামী দুবছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের ভাগ্য অনেকটাই ঠিক করে দেবে এ নির্বাচন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও উপদেষ্টাদের বিশ্বাস, ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি লড়বেন কি না, তা এই মধ্যবর্তী নির্বাচনেই স্থির হয়ে যাবে। খবর রয়টার্সের।
মধ্যবর্তী নির্বাচনে একজন নতুন প্রেসিডেন্টের দল সাধারণত কংগ্রেসে আসন হারায়। তবে ৭৯ বছর বয়সি বাইডেনের দিকে এবার সমালোচনার তির ও মনোযোগ দুটোই বেশি।
সম্প্রতি, ২ নভেম্বর, বাইডেন ও তার উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, তিনি ফের নির্বাচনে লড়ার পরিকল্পনা করছেন। আগামী নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে পরিকল্পনাও সাজাতে শুরু করেছেন তারা। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারাও মনে করছেন, বাইডেন নির্বাচনে অংশ নেবেন।
তবে কিছু ডেমোক্র্যাট বলছেন, ডেমোক্র্যাটরা যদি বড় ব্যবধানে হেরে যায় তবে একে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের মুখে চপেটাঘাত হিসেবেই দেখা হবে। এবং এর ফলে তার ওপর পদত্যাগের চাপ আরও বাড়বে।
ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেনশিয়াল ইতিহাসবিদ টমাস অ্যালান শোয়ার্টজ বলেন, আমি মনে করি, প্রজন্মগত পরিবর্তনের সময় এসেছে। মধ্যবর্তী নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ডেমোক্র্যাটরা যদি বাজেভাবে হেরে যায়, তাহলে ২০২৪ সালে নির্বাচন না করার জন্য বাইডেনের ওপর বড় চাপ থাকবে।
তবে বাইডেন সরে দাঁড়ালেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে তিনি সরে দাঁড়ালেও কিছু নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে।
প্রার্থী কে হবে?
সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে ডেমোক্র্যাট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে ডেমোক্র্যাটদের হাতে থাকা সবচেয়ে ভালো বিকল্প প্রার্থী হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস। সিংহভাগ জরিপে বাইডেনের পরপরই তার অবস্থান। অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের চেয়েও অনেক এগিয়ে রয়েছেন তিনি।
ভোটারদের কাছে প্রিয় নাম মিশেল ওবামা অবশ্য এই দৌড়ে নাম লেখানোর আগ্রহ দেখাননি। এছাড়া ইতিহাস বলে, যেসব ভাইস প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন চান, সাধারণত তারাই জয় পান।
কিন্তু কামালা হ্যারিসের পক্ষে একসময় ৫০ শতাংশের বেশি জনমত থাকলেও সম্প্রতি বেশিরভাগ জরিপে তা ৪০ শতাংশ বা তার নিচে নেমে এসেছে। তিনি একজন রিপাবলিকান প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারবেন কি না, এ ব্যাপারে মানুষ নিশ্চিত হতে পারছে না। কারণ ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের দৌড়ে তিনি ভাল করেননি। এছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও কোনো বড় নীতিতে জিততে পারেননি।
বাইডেন যদি সরে দাঁড়ান, সেক্ষেত্রে কট্টর ডেমোক্র্যাটপন্থি তিন রাজ্যের তিন গভর্নর—ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যাভিন নিউসম, ইলিনয়ের জেবি প্রিটজকার ও নিউ জার্সির ফিল মারফি—ইতিমধ্যে সম্ভাব্য দাতা ও কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ সেরে রেখেছেন। তিনজনের কেউই প্রাথমিক মনোনয়নের লড়াইয়ে বাইডেনের বিরুদ্ধে লড়বেন না, এবং তারা কামালা হ্যারিসকে সমর্থন দিতে পারেন।
একজন সিনিয়র ডেমোক্র্যাট জানিয়েছেন, নিউসম মানুষকে বলেছেন যে তিনি বাইডেন বা হ্যারিসের বিরুদ্ধে লড়বেন না। তবে নিউসম ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করার বিষয়ে মনোভাব বদলাতে পারেন বলে জানিয়েছেন ওই ডেমোক্র্যাট।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে নিউসম, প্রিটজকার ও মারফি—কারও অফিসই মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে চেয়েও মনোনয়ন না পাওয়া একাধিক নেতা এবার ফের দৃশ্যপটে আবির্ভূত হতে পারেন।
অলাভজনক সংস্থা ওপেন সিক্রেটস সেপ্টেম্বরে জানিয়েছে, ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদে লড়বেন বলে গুজব রয়েছে এমন প্রায় ২০ জন রাজনীতিবিদ ইতিমধ্যে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৫৯১ মিলিয়ন ডলারের বেশি তহবিল জোগাড় করে ফেলেছেন। এই রাজনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছেন নিউসম, প্রিটজকার, মিনেসোটার সিনেটর অ্যামি ক্লোবাচার, ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং পরিবহন সচিব পিট বুটিগিগ।
ওপেন সিক্রেটস এক হিসাবে দেখেছে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে। এই ব্যয় আগের তিনটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রত্যেকটির ব্যয়ের দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২০ সালে এত অর্থ ব্যয় হয়েছে ক্ষুদ্র দাতাদের সুবাদে।
প্রচারাভিযানের অর্থবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্যয় বাড়াতে পারে, ডেমোক্র্যাটদের এমন যেকোনো প্রাথমিক লড়াই ২০২৪ সালে দলটির আর্থিক শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
প্রাথমিক ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন
গত কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাথমিক ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনার দ্বারপ্রান্তে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটি (ডিএনসি)। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দল কাকে বেছে নেবে, তাকে প্রভাবিত করতে পারে এই পরিবর্তন।
আইওয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে দীর্ঘদিন ধরেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত করার প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। কিন্তু রাজ্য দুটির মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে প্রায় ৯০ শতাংশ ও ৯৩ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ। অর্থাৎ এই রাজ্য দুটিতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভোটারদের প্রতিফলন নেই—কেননা পিউ রিসার্চের হিসাব অনুসারে, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মোট ভোটারের ৪০ শতাংশই অশ্বেতাঙ্গ।
বদলে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী নির্বাচনের প্রাথমিক লড়াই হতে পারে সাউথ ক্যারোলিনা, নেভাডা বা মিশিগানে। এবারও যদি নির্বাচনে বাইডেনের বিরুদ্ধে কেউ না দাঁড়ায়, তবে পরিবর্তনগুলো খুব একটা পার্থক্য গড়তে পারে না। যত যা-ই হোক, বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক মনোনয়ন জিতেছিলেন সাউথ ক্যারোলিনার সহায়তায়ই।
তবে বাইডেন যদি সরে দাঁড়ান, তবে বড়সড় তোলপাড় সৃষ্টি হতে পারে।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পরামর্শদাতা ক্যারেন ফিনে বলেন, 'এটি নাটকীয় প্রভাব ফেলবে। প্রাক্-লড়াইটা অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় হবে। …এতে প্রার্থীরা অনেক বেশিসংখ্যক ইস্যু নিয়ে কথা বলতে পারবেন। এবং পরিণতিতে আগের চেয়ে ভালো প্রার্থী বেরিয়ে আসতে পারে।'
ডিএনসি-র রুলস অ্যান্ড বাইলজ কমিটি এ বিষয়ে ডিসেম্বরের শুরুতে বৈঠক করবে বলে আশা করা হচ্ছে। জানুয়ারির প্রথম দিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
এলবিজে ও ১৮৬০-এর দশক থেকে পাওয়া শিক্ষা
জো বাইডেনই কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে না লড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবেন না।
এর আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করে সতীর্থদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন। এরপর ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গোটা দেশকে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ১৮৬০-এর দশকে পরপর একাধিক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট কেবল এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, দুই দলের জন্য ফলাফল একেবারেই আলাদা ছিল। জনসন দক্ষিণ ভিয়েতনামে শান্তির আহ্বান জানিয়ে এবং ঘাটতি কাটাতে কংগ্রেসকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা দিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। জনসন বলেছিলেন, আমেরিকানরা যখন বিদেশে মারা যাচ্ছে, তখন তিনি 'পার্টির কাজে' সময় কাটাতে পারেন না।
তার পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় আসেন রিপাবলিকান রিচার্ড নিক্সন।
তবে ডেমোক্র্যাটরা জনসনের পদত্যাগের পর ক্ষমতা রাখতে না পারলেও ১৮০০-র দশকের শেষের দিকে জাতীয় বিভাজন, গৃহযুদ্ধের পর সৃষ্ট ব্যাপক ক্ষোভ প্রভৃতি সত্ত্বেও হোয়াইট হাউসের দখল ধরে রাখে রিপাবলিকানরা।
ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জেরেমি সুরি বলেন, আমি মনে করি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও হোয়াইট হাউসের এ ধারণা পুষে রাখা উচিত নয় যে হোয়াইট হাউসের দখল ধরে রাখার জন্য প্রতিবার একই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।