যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন বিশ্ব রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনতে পারে?
বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামীকাল ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। ইউক্রেন যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে এবার উত্তপ্ত পুরো বিশ্ব। এরই মধ্যে নির্বাচনের পর কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে কারা এগিয়ে থাকবে তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।
সাধারণত মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল খারাপ করে থাকে। সেই অনুযায়ী রিপাবলিকানরা যদি এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তাহলে পুরো বিশ্বেই তার প্রভাব পড়তে চলেছে। কিন্তু কংগ্রেসের পট পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কী ভূমিকা রাখবে? বিশ্ব রাজনীতিতেই বা কী ধরনের পরিবর্তন আসবে? যুক্তরাষ্ট্র কি ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাবে? বাইডেন কি চীনের ওপর আরও কঠোর হবেন?
এখানেই শেষ নয়, রিপাবলিকানরা নিজেরাই যখন বিভক্ত হয়ে পড়ছে, তখন কোন পক্ষের জয়ের সম্ভাবনা বেশি? ইরানের বিষয়েই বা মার্কিন প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিবে? এসব প্রশ্ন নিয়েই মুখোমুখি আলোচনা করেছেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসির একদল প্রতিবেদক। পরিস্থিতি কতটুকু বদলাতে পারে তা তাদের আলোচনা থেকে দেখে নেওয়া যাক।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে
কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় আসলেই একের পর এক তদন্ত শুরু হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি অভিশংসন প্রস্তাবও উঠতে পারে। সরকারের শাসন ব্যবস্থায় এই তদন্তগুলো কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
এমন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রতিবেদক অ্যামি ম্যাকিনন। তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস চার বছর ডেমোক্র্যাটদের দখলে থাকায় রিপাবলিকানরা অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তারা এবার দখল নিলে কোন কোন বিষয়ে তদন্তে ছাড় দিবে এটা হলো প্রশ্ন।'
রিপাবলিকানদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই এই ধারণা আছে যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে তদন্ত করা হয়েছিল। দেশের ভেতর সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের সংস্থাকেই তদন্তের আওতায় আনা হবে। বৈষম্য বিরোধী ও সামাজিক দায়বদ্ধতা এখন বড় বড় করপোরেশনগুলোর ব্যবসার মূল হাতিয়ার। ন্যায্য মূল্যে আসল পণ্য বিক্রির মতো বিষয়গুলো উপেক্ষিত বলে মনে করছেন অনেকে।
বাইডেন পুত্র হান্টার বাইডেনের ওপরেও এবার জোর নজর পড়তে চলেছে। ২০১৮ সাল থেকেই হান্টারের বৈদেশিক বাণিজ্য, কর ফাঁকিসহ বন্দুক কেনায় মিথ্যা বিবৃতি প্রদান নিয়ে তদন্ত চলছে। এবার তাতে আরও ভালোভাবেই ফাঁসবেন বাইডেন জুনিয়র।
এছাড়া ইমিগ্রেশন নিয়ে সেক্রেটারি অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আলেজান্দ্রো মায়োরকাসও অভিশংসিত হতে পারেন। ইমিগ্রেশনের ওপর এবার ভালো জোর দেওয়া হবে।
পররাষ্ট্র নীতিতে যা গুরুত্ব পাবে
'রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে দেশের বাইরে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে আফগানিস্তান গুরুত্ব পাবে। আফগানিস্তানে কী ভুল হয়েছিল সে বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন নীরবতা বজায় রেখে গেছে। আফগান সরকার কীভাবে এত দ্রুত ভেঙে পড়ল আর আফগান সেনারাই কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনও কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। আমরা ইতোমধ্যে রিপাবলিকান হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রতিবেদনে এর আভাস দেখতে পেয়েছি', বলেন ম্যাকানন।
অপর যে বিষয়ে রিপাবলিকানরা জোর দেবে তা হলো কোভিড-১৯। এই ভাইরাসের উৎপত্তি কীভাবে হলো এবং বাইডেন প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল সেই তদন্তে নামবে তারা।
ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ কি অব্যাহত থাকবে?
ইউক্রেনে এই মধ্যবর্তী নির্বাচন কী ধরনের প্রভাব ফেলবে এমন প্রশ্নের উত্তরে ম্যাকিনন বলেন, কিয়েভ এই নির্বাচনের ওপর নজর রাখছে। মস্কোও খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি দেখছে। ইউক্রেনীয়রা খুব বেশি চিন্তিত নয়। দুদলই ইউক্রেনকে সমর্থন জানাবে বলেই মনে করছে তারা। আর তাই ভবিষ্যতেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা অব্যাহত থাকার বিষয়ে আশাবাদী ইউক্রেন।
কিন্তু তাও বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক কোনো রাষ্ট্র যে পরিমাণ সহায়তা দিচ্ছে তা কিন্তু আর কোনো দেশই দিচ্ছে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সামান্যতম পেছালেও ইউক্রেন যুদ্ধে তার বড় প্রভাব পড়বে। তাই বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছে তারা।
চীনের সঙ্গে বরফ গলার সম্ভাবনা নেই
কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে কী হবে? ধারণা করা হচ্ছে বাইডেন প্রশাসনও চীনের বিষয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর নীতিই অনুসরণ করছে। বেইজিংয়ের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রয়েছে। নাটকীয়ভাবে দেশে চীনা প্রযুক্তির প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। চীনের সঙ্গে এই রেষারেষির ওপর মধ্যবর্তী নির্বাচন কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
চীনা নীতি প্রসঙ্গে জ্যাক ডেচ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা রাস্ট বেল্ট অঞ্চলগুলোতে ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা গেছে। এই স্টেটগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ছিন্ন করতে আগ্রহী। ফলে এখানে নির্বাচনে জয় লাভ একধরনের বাণিজ্য যুদ্ধের ওপর নির্ভর করছে। বাইডেন প্রশাসন এখানে চিপ অ্যান্ট নিয়ে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী চীন থেকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোতে সেমি কন্ডাক্টর উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হবে যাতে কর্মসংস্থানও বাড়ে।
এর বাইরে নতুন প্রজন্মের রিপাবলিকানদের অনেকে আছেন যারা জিতে গেলে তাইওয়ানের মতো অঞ্চলগুলোকে সশস্ত্রভাবে সংগঠিত করে তোলার চেষ্টা করবেন।
কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা আসলে তারা চীনের প্রতি আরও কঠোর অবস্থান নিবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে ম্যাকানন বলেন, আমার মনে হয় চীন সম্পর্কিত নীতি খুব একটা পরিবর্তিত হবে না। বাইডেন আসার পরেও ট্রাম্পের নীতিতে তেমন পরিবর্তন দেখা যায়নি।
রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট কারও কাছেই ছাড় পাবে না ইরান
ইরানের ক্ষেত্রে পরমাণু চুক্তিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে রোবি গ্র্যামার বলেন, পরমাণু চুক্তি নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো ভাবনা নেই। বাইডেন প্রশাসনের ইরানের এক শীর্ষ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কিছুদিন আগে কথা হলে তিনি জানান পরমাণু চুক্তির পেছনে এখন আমরা কোনো সময় নষ্ট করব না। আমার মনে হয় রিপাবলিকানরা এই বিষয়টিকে স্রেফ বাইডেনের পেছনে লাগতে ব্যবহার করবে। তারা বলবে বাইডেন প্রশাসন ইরানের প্রতি উদার।
তবে আমার তা মনে হয় না। ইউক্রেন যুদ্ধে আগুনে ঘি ঢালছে ইরান। ইউক্রেনে ইরানি ড্রোন ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার বাড়াচ্ছে রাশিয়া। অন্যদিকে নারী অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারীদের দমন-পীড়নেও ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। এসবের মধ্যে তাই বাইডেন প্রশাসনও পরমাণু চুক্তির ক্ষেত্রে ইরানকে খুব বেশি ছাড় দিবে না।