‘বড় যুদ্ধ ফিরে এসেছে’: ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ৫ শিক্ষা
তীব্র শীতের মৌসুমে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে অভিযান চালায় মস্কো। পরিকল্পনা ছিল প্রধান বিমানবন্দরের দখল এবং প্রেসিডেন্টকে হত্যাসহ রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। ১৯৭৯ সালে রুশ সাঁজোয়া বহর যখন সীমান্ত অতিক্রম করে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে, তখন ক্রেমলিনের প্রত্যাশা ছিল অচিরেই দেশটি তাদের অধীনস্থ হবে। খবর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের
চার দশক পর একই ধরনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়ে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর মাধ্যমে চটজলদি কিয়েভ সরকারের পতন আশা করেছিলেন তিনি।
রাশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক মার্ক গ্যালোত্তি বলেছেন, 'সোভিয়েত আমলে ক্রেমলিনের একদল বয়স্ক ব্যক্তি যেভাবে আফগানিস্তানে আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নেন, তার সাথে বর্তমান সময়ের ক্রেমলিন জ্যেষ্ঠদের ইউক্রেনে আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই সামরিক বাহিনী আগ্রাসনকে সঠিক উপায় মনে করেনি, কিন্তু তাদের মতামতকে আমলে নেওয়া হয়নি'।
তার এই মন্তব্যের প্রামাণ্য দলিল– স্বয়ং ইতিহাস। মস্কোর আফগানিস্তান আগ্রাসন- ১০ বছরব্যাপী দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। এতে প্রাণ হারায় ১৫ হাজার সোভিয়েত সেনা। অন্যদিকে, ১০ মাসের যুদ্ধেই ইউক্রেনে অন্তত এক লাখ রুশ সেনা হতাহতের দাবি করছে পশ্চিমা বিশ্ব ও কিয়েভ।
রাশিয়া কিয়েভ দখলে নিতে ব্যর্থ হয়েছে, তারপর প্রথমদিকের দখলীকৃত অর্ধেক এলাকা থেকে রুশ বাহিনীকে তাড়িয়েছে ইউক্রেনীয়রা। তবু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ধনুর্ভঙ্গ পণে অনড় মস্কো। এই মুহূর্তে, ইউক্রেনীয়রা বার বার তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সতর্ক করে বলছে– রাশিয়া আরও একবার কিয়েভমুখী অভিযানের পরিকল্পনায় ব্যস্ত।
এই পরিস্থিতিতে, ইউক্রেনে চলমান এই সংঘাত থেকে কোন শিক্ষাগুলো নেওয়া যেতে পারে এবং ২০২৩ সালে এই সংঘাতের গতিপ্রকৃতিই বা কোনদিকে যাবে? এসবের ক্ষেত্রে একটি প্রধান ব্যাখ্যা দিচ্ছেন- সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বৃহৎ যুদ্ধ আবারো ফিরে এসেছে। আর এ ধরনের যুদ্ধে জিততে হলে– একটি দেশের অস্ত্র উৎপাদনের দরকারি শিল্প সক্ষমতা এবং তীব্র লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো বিপুল মজুতও থাকতে হবে।
ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমা মিত্রদের সামরিক সহায়তাকে তাদের 'কৌশলগত গভীরতা' বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী জেমস হিপ্পে। পশ্চিমারা এপর্যন্ত ৪ হাজার কোটি ডলারের সামরিক ত্রাণ পাঠিয়েছে। ১৮৫ কোটি ডলারের একটি নতুন সহায়তা প্যাকেজের আওতায় ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দিতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তারপরও, যুদ্ধ ইউক্রেনের বাইরে ইউরোপের অন্য দেশেও ছড়াক এটা চায় না পশ্চিমা দুনিয়া। কারণ তাতে রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাত বাঁধবে ন্যাটোর। এজন্যই ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক ট্যাংক, দূরপাল্লার মিসাইল ও যুদ্ধবিমান সরবরাহের বিপক্ষে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটটি।
লন্ডনের কিংস কলেজের রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাত বিশেষজ্ঞ ডোমিতিল্লা সাগরামোসো বলেন, '২০২৩ সালের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো– নতুন বছরে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে কতটুকু সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখবে, এবং কী ধরনের সহায়তা দেবে'।
এখানে শিক্ষণীয় হলো– সহায়তারও একটা সীমা আছে।
মস্কোর জন্য তৃতীয় শিক্ষাটি হচ্ছে, সমরাস্ত্রের সংখ্যার চেয়ে মানের গুরুত্ব অনুধাবন। উন্নত সরবরাহ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পরিমাণে সেনা, যথেষ্ট পরিমাণে সেনা সরঞ্জাম– হোক সে ড্রোন বা ট্যাংক– 'এগুলো কোনো কাজেরই নয় যদি সামরিক তথ্যসংগ্রহ, নেতৃত্ব অযোগ্য হয়'-- ব্যাখ্যা করেন বেন ব্যারি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই ব্রিগেডিয়ার বর্তমানে চিন্তক সংস্থা– ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে যুক্ত আছেন।
তার মতে, 'রুশ বাহিনী যৌথ অভিযান পরিচালনায় (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ব্যবহারে) এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্বে দুর্বল মানের পরিচয় দিয়েছে, রুশ বাহিনীর মনোবলেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে'।
এসব ঘাটতি পূরণে গত অক্টোবরে ইউক্রেন যুদ্ধের সার্বিক ভার জেনারেল সের্গেই সুরভিকিনকে দেন পুতিন। সিরিয়া যুদ্ধের অভিজ্ঞ এই সেনানায়ক 'এ দায়িত্ব নেওয়া সবচেয়ে যোগ্য রাশিয়ান কমান্ডার' বলে মন্তব্য করেন দারা ম্যাসিকট। তিনি খ্যাতনামা প্রতিরক্ষা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র্যান্ড কর্পোরেশনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী বিশেষজ্ঞ।
সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ তলব এবং ভর্তির মাধ্যমে– যুক্ত হওয়া ৩ লাখ সেনাকে যুদ্ধের সম্মুখভাগে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী করতে নিয়োজিত করেছেন সুরভিকিন। দক্ষিণের খেরসন শহর থেকেও তিনি সুপরিকল্পিতভাবে সেনা প্রত্যাহার বাস্তবায়ন করেছেন।
প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান শক্তিশালী হওয়ায়– শীতকালে ইউক্রেনীয় পাল্টা-আক্রমণে রুশ বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিও অনেকটাই কমেছে। তবে এখনও ইউক্রেনীয়দের আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকরা।
পশ্চিমা একটি দেশের সামরিক পরামর্শক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, 'ইউক্রেনীয় বাহিনীরও নিজস্ব সমস্যা আছে। তাদের অনেক সদস্য হতাহত হয়েছে, অনেকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত নয়। কিছু সেনা ইউনিট টানা লড়াইয়ের ফলে চরম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদও দরকার। তবে এটাও ঠিক, প্রতিপক্ষের তুলনায় তাদের মনোবল চাঙ্গা, সেনা সমাবেশের দিক থেকেও তারা রাশিয়ানদের চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে'।
চতুর্থ শিক্ষাটি হচ্ছে, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে নাগরিক সমাজের অব্যাহত ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। এটি থাকার ফলেই, রাশিয়ান লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সহায়ক এমন অ্যাপ তৈরি করে সামরিক বাহিনীকে দেন ইউক্রেনের সফটওয়্যার প্রোগ্রামাররা। শেফরা সেনাদের জন্য রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে গিয়ে রান্না করেছেন, অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবীরা তহবিল সংগ্রহ করে সেই টাকায় সামরিক রসদ, ওষুধ, যন্ত্রপাতি, নাইটভিশন ইত্যাদি কিনে দিয়েছেন।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক টিমোথি স্নাইডার বলেন, 'যুদ্ধের ময়দানে ইউক্রেনীয় সেনাদের বেশিরভাগ সাফল্যই নির্ভরশীল– তাদের আত্মপ্রত্যয়ী নাগরিক সমাজের সর্বস্তরের সমর্থন, সহায়তার ওপর'।
অক্টোবরে পরিচালিত গ্যালোপের এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ৭০ শতাংশ ইউক্রেনীয়। তাদের ৯০ শতাংশ মনে করেন, ২০১৪ সালে রাশিয়ার অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপ স্বাধীন করার মাধ্যমেই এই বিজয় অর্জিত হবে।
অন্যদিকে, রাশিয়া থেকে নির্বাসিত ও অনির্ভরযোগ্য একটি গণমাধ্যম মেডুজার সূত্রে পশ্চিমারা দাবি করছে, চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ক্রেমলিন একটি গোপন জরিপ চালায়। এতে দেখা গেছে, মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৭ শতাংশ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
এই যুদ্ধের পঞ্চম ও সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি হলো– এটি একাধিক রণাঙ্গনে সংগঠিত হচ্ছে। আর যুদ্ধ শুধু ট্যাংক, কামান আর বন্দুক দিয়েই হচ্ছে না।
ইউক্রেনের শিল্প সক্ষমতাকে ধবংস করতে দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামোয় নিরন্তর ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছেন পুতিন। তার কৌশল হলো– এতে দেশটির জাতীয় মনোবলে ধস নামবে আর শরণার্থীর ঢল নামবে ইউরোপে। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজ উদ্যোগেই রাশিয়ার সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেবে, বা শান্তি আলোচনার জন্য ইউক্রেনকেই উল্টো চাপ দেবে।
পশ্চিমাদের আরও চাপে রাখতে শীতের শুরুতেই তাদের জন্য গ্যাস সরবরাহ আরও কমিয়ে দেন পুতিন। আপাতত, জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্ততায় ইউক্রেন বিশ্ববাজারে শস্য রপ্তানি করতে পারলেও, ভুলে গেলে চলবে না কৃষ্ণসাগরের নিয়ন্ত্রণ রুশ নৌবাহিনীর হাতে। তারা চাইলে যেকোনো মুহূর্তে এই বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারবে।
বিশেষজ্ঞ মার্ক গ্যালোত্তি বলেন, 'পুতিন এ বার্তাই দিয়েছেন যে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে, তবে আমি যতদিন চাই- এটা চালিয়ে যেতে পারব। পশ্চিমাদের সাথে ইউক্রেনের দূরত্ব সৃষ্টি করার এটা একটা রাজনৈতিক কৌশল। তাই বলা যায়, এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি শুধুমাত্র সামরিক সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করবে না'।
এমনকী উভয়পক্ষ যদি সামনের বছরগুলোয় লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে যুদ্ধবিরতিতেও সম্মত হয়, তারপরও ইউক্রেনের ওপর ভিন্ন উপায়ে আগ্রাসন চালিয়ে যাবেন পুতিন। গ্যালোত্তি বলেন, 'আধুনিক যুদ্ধের চরিত্র হয়তো বদলাচ্ছে, কিন্তু একইসঙ্গে বদলাচ্ছে শান্তির সংজ্ঞাও। আর এই ব্যাপারটা নিয়ে পশ্চিমাদের ভাবা উচিত'।