সাবেক পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কীভাবে হবে? কী পরিবর্তন থাকবে?
পোপ হলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু, যার প্রধান কার্যালয় রোম শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ভ্যাটিকান সিটিতে। সাধারণত বর্তমান পোপের মৃত্যু হলেই আরেকজন পোপ নির্বাচিত হন। কিন্তু এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে সদ্য প্রয়াত সাবেক পোপ বেনেডিক্টের ক্ষেত্রে।
'বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য জটিলতার' কথা উল্লেখ করে ২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে বেনেডিক্ট তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। গত দীর্ঘ ৬০০ বছরের মধ্যে তিনিই একমাত্র পোপ, যিনি আজীবন পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরিবর্তে পদত্যাগ করেছিলেন। অর্থাৎ, গত ছয় শতাব্দী ধরে বেনেডিক্ট ব্যতীত সব পোপের দায়িত্বের মৃত্যুর মাধ্যমেই অবসান ঘটেছে।
নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে দায়িত্বে আসীন পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু সাবেক পোপের ক্ষেত্রে কী করা হবে? ক্যাথলিক চার্চের সামনে যে এমন পরিস্থিতি অনেকটা অভূতপূর্ব ! পদত্যাগ করার ঘটনা চার্চের ইতিহাসে প্রথম না হলেও, দায়িত্ব ছাড়া পর সাবেক পোপের ভ্যাটিকানেই থেকে যাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
গত বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস সাবেক পোপ বেনেডিক্ট 'গুরুতর অসুস্থ' বলে জানালে, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে।
'বার্ধ্যক্যজনিত' কারণে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার প্রায় এক দশক পর তার ভ্যাটিকানের বাসভবনে শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) মারা যান সাবেক পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট। তার মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কিত জল্পনা আরও বেশি আলোচনায় এসেছে। খবর ডয়েচে ভেলের।
ভ্যাটিকান এবং এর ইতিহাস নিয়ে একাধিক বইয়ের লেখক এবং জার্মান সাংবাদিক উলরিশ নেরসিনজার এই সাবেক পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে বলেন, 'এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি। এর সবকিছুই এখন কেবল অনুমানমূলক। এমনকি যারা এসব কাজে অভিজ্ঞ তাদের জন্যেও এখন কী করা উচিত - তা জানা কঠিন।'
গির্জা সম্পর্কিত ইতিহাসবিদ আলবার্তো মেলোনি জানান, ষোড়শ বেনেডিক্টের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে সরল হবে। তিনি মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপিকে বলেন, 'একজন পোপ ইমেরিটাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হলো রোমের বিশপ ইমেরিটাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সমকক্ষ। আর অবসরপ্রাপ্ত বিশপদের মৃত্যুর পর কীভাবে সম্মান করা যায়, সে বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলে আসছে।'
আসতে পারে নতুনত্ব
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এ ব্যবস্থায় অন্তত কিছু আশুরচনার প্রয়োজন হবে। নেরসিনজার বলেন, 'একটি বিষয় আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, এটি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দায়িত্বরত পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো হবে না। যেমন, পোপের মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং পোপের কক্ষ বন্ধ করার মতো কিছু প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান নাও মানা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম ডেইলি মেইল-এর খবর অনুসারে, সদ্য প্রয়াত সাবেক পোপ বেনেডিক্টের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শোকাহতদের জন্য সোমবার (২ জানুয়ারি) থেকে তার মরদেহ ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হবে।
এক্ষেত্রে বেনেডিক্টের মরদেহ কীভাবে উপস্থাপন করা হবে সেটিও বিবেচনার বিষয়। এবং এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন নেরসিনজার। তিনি বলেন, 'সাধারণত পোপের মরদেহ শোকার্তদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য উপস্থাপনকালে তাকে পোপের বিশেষ পোশাক এবং বিশেষ আলখাল্লা (প্যালিয়াম) পরানো হয়। আমি মনে করি না যে তাকে এসব পরানো হবে।'
এছাড়াও, আগামী বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারী) পোপ ফ্রান্সিসের সভাপতিত্বে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে- এমনটা জানায় ডেইলি মেইল।
সুতরাং পোপ বেনেডক্টের ক্ষেত্রে নোভেনডিয়ালি নামক এক রীতি অনুসৃত হচ্ছে না। এ রীতি অনুসারে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্বরত পোপের মরদেহ নয় দিন ব্যাপী জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করে রাখা হয়, যাতে শোকার্তরা সারি করে পোপকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
অবশ্য, এত দীর্ঘদিন রাখার আরেকটি কারণ হলো, যাতে করে নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। নেরসিনজার জানান, এক্ষেত্রে নতুন পোপ নির্বাচন করার প্রয়োজন নেই বলে নয়দিন ব্যাপী এই রীতি পালনেরও প্রয়োজনীয়তা নেই।
সমাহিত করার ক্ষেত্রে বেনেডিক্ট উইলে কী লিখে গেছেন সেটিও বিবেচ্য।
'স্বভাবতই অনুষ্ঠানের পোপ মাস্টাররা প্রয়াত সাবেক পোপের জন্য কিছু পরিকল্পনা তৈরি করবেন, তবে বেনেডিক্ট নিজে তার উইলে কী ইচ্ছা পোষণ করেছেন তার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে,' যোগ করেন তিনি।
বেনেডিক্টের আনুষ্ঠানিক জীবনীকার, পিটার সিওয়াল্ড ২০২০ সালে জার্মান গণমাধ্যম পিএনপিকে বলেছিলেন, 'অবসরপ্রাপ্ত পোপ বেনেডিক্ট একটি উইল রয়েছে, যা তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হবে।' সেসময় তিনি আরও জানিয়েছিলেন, বেনেডিক্ট তার পূর্বসূরি পোপ দ্বিতীয় জন পলকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছিল, সেই একই সমাধিকক্ষে সমাহিত হতে চান।
সাধারণত বর্তন পোপ প্রাক্তন পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান সভাপতিত্ব করেন। একই রীতিতে পোপ বেনেডিক্টও তার আগের পোপ জন পলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান সভাপতিত্ব করেন। ডেইলি মেইল জানায়, আগামী ৫ জানুয়ারি, বেনেডিক্টের শেষকৃত্য বর্তমান পোপ ফ্রান্সিসের সভাপতিত্বে হতে পারে।
দুই পোপের মধ্যকার সম্পর্ক
পোপের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেও ভ্যাটিকান সিটিতেই বাস করে যান বেনেডিক্ট। একই শহরে বাস করা এই সাবেক এবং বর্তমান পোপের সম্পর্ক গত নয় বছর ধরে নানা আলোচনায় ছিল (কোনো অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রের চেয়ে কম নয়!)।
বেনেডিক্ট প্রায়শই তার উত্তরাধিকারী অর্থাৎ পোপ ফ্রান্সিসের সাথে তার সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে 'গভীর যোগাযোগ' এবং 'বন্ধুত্ব' - শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে ফ্রান্সিস বেনেডিক্টকে তার 'ভাই' হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই দুই ব্যক্তির মধ্যে সুপরিচিত পার্থক্য রয়েছে।
'তারা দু'জন আলাদা ব্যক্তি, যারা খুব ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছেন, এবং তাদের ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন,' বলেন নেরসিনজার।
বেনেডিক্ট এবং ফ্রান্সিস মাঝে মধ্যে একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। উদাহরণস্বরূপ, পোপ ফ্রান্সিস যখন নতুন কার্ডিনাল নিয়োগ করেছিলেন তখন তিনি প্রায়ই নতুন কার্ডিনাল ছাড়াও বেনেডিক্টের সঙ্গেও দেখা করতেন।
পদত্যাগের সময় বেনেডিক্ট কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে যা অনেকের মতে, তাদের দুইজনের সম্পর্কে বৈরীভাব এনেছে বলে মনে করেন অনেকে। যেমন, তিনি পোপের বিখ্যাত বিশেষ সাদা পোশাক পরা অব্যাহত রেখেছিলেন। এছাড়াও পোপের শিরোনামটি রেখে দেন বেনেডিক্ট, যদিও তার ইমেরিটাস মর্যাদা ছিল এবং পোপদের 'হোলি ফাদার' (পবিত্র পিতা) সম্বোধনও অব্যাহত রাখেন।
'তার এমন কিছু সিদ্ধান্ত অনুসারীদের মধ্যে অন অসন্তোষ তৈরি করেছিল এবং তাদের বিভ্রান্ত করেছিল,' বলেন নেরসিনজার। তিনি আরও যোগ করেন, 'আমি মনে করি এসব সিদ্ধান্তের কী কী নেতিবাচক পরিণতি হতে পারে - তা বেনেডিক্ট বুঝতে পারেননি। তাছাড়া এমন অনেক লোক আছে যারা দুই পোপকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর পায়তারায় ছিলেন।'
সাবেক পোপ বেনেডিক্ট স্বভাবে কছুটা 'আনুষ্ঠানিক' ছিলেন এবং দায়িত্বে থাকাকালে খুব কম রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন।
অনেক গির্জার পর্যবেক্ষক মনে করেন, পোপ বেনেডিক্টের অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত এমন একটি নজির তৈরি করেছে যেটি হয়তো বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস অনুসরণ করতে পাতেন। ৮৬ বয়সী ফ্রান্সিসও বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। তবে নেরসিনজার এ বিষয়ে একমত নন। ফ্রান্সিস পোপের পদমর্যাদা বেশ উপভোগ করেন বলে মনে করেন তিনি।