মাটিতে তলিয়ে যাচ্ছে জোশীমঠ; সম্পূর্ণভাবে ধসে যেতে পারে শহরটির বড় অংশ
ভারতের উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় অবস্থিত জোশীমঠ শহরের একটি বড় অংশ সম্পূর্ণভাবে ধসে যেতে পারে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরো। খবর বিবিসি ও আনন্দবাজার পত্রিকার।
উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরটির দু'টি ভিন্ন সময়কালের ভূমি বসে যাওয়ার ছবি তুলনা করে চমকে যাওয়ার মত তথ্য দিয়েছে ইসরোর ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার (এনআরএসসি)।
এনআরএসসি-র মতে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে 'কার্টোস্যাট-২ এস' উপগ্রহের মাধ্যমে সেন্টিনেল-১ এসএআর ইমেজরি যন্ত্র দিয়ে ডিআইএনএসএআর কৌশল ব্যবহার করে ছবিগুলো তোলা হয়েছিল। প্রথমে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে অর্থাৎ, গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জোশীমঠের বিস্তীর্ণ এলাকার ছবি ওই উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা হয়।
প্রথম ধাপের ছবি দেখে জোশীমঠ তলিয়ে যাচ্ছে বলে অতটা ধারণা করা যায় না। যদিও সেই ছবি উদ্বেগ তৈরি করার জন্য যথেষ্ট বলে ইসরো মনে করছে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এপ্রিল থেকে নভেম্বর, এই সাত মাসের ব্যবধানে ৮.৯ সেমি মাটির তলায় ঢুকে গেছে জোশীমঠ।
অন্যদিকে দু'মাস যেতে না যেতেই দেখা গেছে একেবারে ভিন্ন চিত্র। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারির মধ্যে উপগ্রহের নেওয়া উপগ্রহচিত্রে দেখা যায়, শহরটির হিমালয়ের জনপদ মাটিতে তলিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে!
মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে তোলা ছবিতে দেখা গিয়েছে জোশীমঠের মাটি ধসে গিয়েছে ৫.৪ সেন্টিমিটার। যে ছবি প্রকাশ্যে আসতেই উদ্বিগ্ন হয়েছে প্রশাসন। প্রচণ্ড আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে স্থানীয়রা।
এছাড়াও শহরটির ভূমিধসের কেন্দ্রবিন্দুতেও বদল এসেছে বলে জানিয়েছে ইসরো। মাটির দিকে অবনমন বেশি বেড়েছে জোশীমঠ শহরের মাঝামাঝি থাকা এলাকায়।
পাশাপাশি, উপগ্রহ থেকে তোলা আরও একটি ছবি পর্যবেক্ষণ করে জোশীমঠের বিস্তীর্ণ এলাকাকে ধসপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপগ্রহ থেকে ৭ জানুয়ারি নেওয়া ছবিতে দেখা যায়, ধসপ্রবণ এই এলাকার মাথা রয়েছে ২১৮০ মিটার উচ্চতায় থাকা জোশীমঠ-আউলি সড়কের কাছে একটি জায়গায়।
ওই এলাকার প্রায় মাঝামাঝি দু'টি কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভারতীয় সেনার হেলিপ্যাড এবং নরসিংহ মন্দির।
জোশীমঠের ভূমিধস ঠেকাতে শহরের একাধিক বাড়িতে মানুষের থাকা নিয়ে আপত্তি তুলেছে প্রশাসন। প্রশাসন 'মালারি ইন' এবং 'মাউন্ট ভিউ' নামে দু'টি বিলাসবহুল হোটেল এবং বেশ কয়েকটি বাড়ি অনিরাপদ বলে ঘোষণা করেছে। খুব শিগগিরই রেড সিগনাল জারি করা ঘরবাড়িগুলিও ভাঙা শুরু হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
হোটেল দুটি ভাঙার কাজ গত বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু হয়েছে। একটি হোটেলের মালিক ঠাকুর সিং রাণা বিবিসিকে বলেন, "২০১১ সালে হোটেলটা বানাতে আমার খরচ হয়েছিল সাত কোটি টাকা। মূল্যবৃদ্ধির পরে এখন কত দাম হতে পারে ভেবে দেখুন। আমি আরও অন্তত দশ বছর কাজ করতে পারতাম। সরকারের তো উচিত এইসব ভেবে আমাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।"
এছাড়াও ২ জানুয়ারি থেকে শুরু করে বিগত কয়েক দিনে জোশীমঠের প্রায় ৭৬০ টি বাড়িতে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। চওড়া ফাটল দেখা গিয়েছে শহরটির রাস্তা-মন্দির-জমিতে।
মৃত্যুভয় গ্রাস করায় রাতারাতি ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে সেই শহরের বহু মানুষ। অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে আশ্রয় শিবিরে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৬৯টি পরিবারকে ত্রাণশিবিরে পাঠানো হয়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া দুর্গা প্রসাদ সাকলানি নামের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, "কেউ ফোন করে খোঁজখবর নিলেই বিরক্তি লাগছে। আত্মীয়রা ফোন করছে, কেমন আছি আমরা জিজ্ঞাসা করছে। কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না আমার। সবাইকে বলছি আজ রাতটা যদি বেঁচে থাকি কাল জানাব কেমন আছি!"
অন্যদিকে জোশীমঠকে 'বসবাসের অযোগ্য' বলেও ঘোষণা করেছে উত্তরাখণ্ড সরকার। তবে এই পরিস্থিতির জন্য স্থানীয় জনগণ সরকারের গ্রহণ করা উন্নয়ন প্রকল্পকেই দায়ী করেছেন।
স্থানীয়দের দাবি, এনটিপিসির জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য যে ১২.১ কিমি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে, তার জন্যই জোশীমঠের মাটি আলগা হয়ে গেছে।
এরইমধ্যে বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী। সেনা, আইটিবিপি, এনডিআরএফের প্রতিনিধি এবং বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী ধামী শহরটির জনসাধারণকে অহেতুক উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বলেও দাবি করেন তিনি।
কিন্তু ইসরোর প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, যে হারে ভূমিধস হচ্ছে, তাতে গোটা জোশীমঠই তলিয়ে যেতে পারে।