বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণভোমরা জ্বালানি ডিজেলের ওপর বিশাল নিষেধাজ্ঞা আসছে
ডিজেল বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। বৈশ্বিক ডিজেল বাজারের একটি নজিরবিহীন অংশ আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আগ্রাসীভাবে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে চলেছে।
এই ঘটনা ঘটবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নেওয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-৭ জোট ও তাদের মিত্ররা রাশিয়ার জ্বালানি তেল রপ্তানির ওপর মূল্যসীমা আরোপের চেষ্টা করবে। ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোয় যা মস্কোকে শায়েস্তা করার সাম্প্রতিকতম উদ্যোগ হবে তাদের। একই সমান্তরালে কার্যকর হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাশিয়া থেকে সব ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি।
রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) রপ্তানির ওপর ইতোমধ্যেই এ ধরনের কিছু নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও– পরিশোধিত তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ও মূল্যসীমা আরোপ– বিশেষ করে ডিজেলের ওপর হওয়ায়– এর দামে চড়া উত্থানের সম্ভাবনা দেখছেন তেল বাজার পর্যবেক্ষকরা।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের আগে রাশিয়াই ছিল ইউরোপের বাজারে সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক। এই বাণিজ্যে বিধিনিষেধ কার্যকরের আগপর্যন্ত বিপুল পরিমাণে জ্বালানি কেনা অব্যাহতও রাখে ইউরোপীয় দেশগুলি। এখন ডিজেলের মতো পরিশোধিত জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে– এই পণ্যের চালান বিশ্বের অন্যত্র বিক্রি করতে হবে মস্কোকে। ফলে ডিজেলের বৈশ্বিক প্রবাহেও আসবে বড় পরিবর্তন। আবার রাশিয়ার ক্রুড ক্রেতারাও রাখবে এক্ষেত্রে ভূমিকা। তারা রাশিয়ান ক্রুড পরিশোধন করে উৎপাদিত জ্বালানি আবার ইউরোপে রপ্তানি করবে। একারণেও দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
লন্ডনের তেল বাজার বিশ্লেষক সংস্থা ওয়েলিটিক্স- এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব লোজিয়া বলেন, 'বাজার থেকে রাশিয়ার সরবরাহ হারানোটা হবে ব্যাপক, এই ঘাটতি পূরণ এক পর্বতপ্রমাণ লজিস্টিকস চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। তবে জ্বালানি বাজারে এখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দাম বাড়ানোর ঘটনা সেভাবে ঘটছে না, তেল বাণিজ্যও ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা দেখিয়েছে। তাই নিষেধাজ্ঞার ফলে ডিজেল চালানের গতিপথ বদলানোর ঘটনাই দেখব আমরা'।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে দিনে ৬ লাখ ব্যারেল ডিজেল আমদানি করছে, যা এখন তাদের ভিন্ন উৎস থেকে কিনতে হবে। আবার রাশিয়াকেও বিশ্বের অন্য ক্রেতার কাছে এগুলো বিক্রি করতে হবে। আর তা করতে না পারলে, উৎপাদিত ডিজেল মজুতের ব্যবস্থা করতে হবে অথবা পরিশোধনাগারে উৎপাদন কমাতে হবে।
ইউরোপে নিজস্ব চাহিদার চেয়ে ডিজেল উৎপাদন কম হওয়ায়, মহাদেশটিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি চালান এরমধ্যেই বেড়েছে। এশিয়ার চীনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিকটবর্তী বাজারে ডিজেল রপ্তানি বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, পরোক্ষভাবে অন্যান্য সরবরাহকারীদের চালান বাড়তে চলেছে।
বাজার গবেষক ও ব্রোকারেজ সংস্থা– বার্নস্টেইন রিসার্চের অসওয়াল্ড ক্লিন্টসহ অন্যান্য বিশ্লেষকরা তাদের গ্রাহকদের প্রতি পরামর্শক নোটে লিখেছেন, 'আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান (জ্বালানি) পণ্যের ওপর ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের সাথে সাথে এই অঞ্চলে অন্যান্য সরবরাহকারীদের চালান বাড়বে, এতে বিশ্বের অন্যত্র আবার ডিজেল সরবরাহে টান টান অবস্থা তৈরি হবে'।
মূল্যছাড় সুবিধায় বর্তমানে রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল (ক্রুড) কিনতে ভারত। একারণে দেশটি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউরোপে ডিজেল সরবরাহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে।
ভারত থেকে ইউরোপে রপ্তানি বৃদ্ধির অর্থ দাঁড়াবে– ব্যাপক পরিমাণে রাশিয়ান ক্রুড কিনে ভারতের পরিশোধনের পর তা ইউরোপে বিক্রি করা হচ্ছে।
এই বাণিজ্যে ইউরোপের বিধিমালা ভঙ্গ না হলেও, এই ঘটনা নিষেধাজ্ঞার অকার্যকারিতা তুলে ধরছে। এই প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ চালান সরাসরি ইউরোপে আসতে না পারায়, প্রথমে হাজার হাজার মাইল দূরে যাবে, আবার সেখান থেকে ভিন্ন বিক্রেতার হাত ধরে ইউরোপে প্রবেশ করবে।
নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিতে চালানের নথি পরিবর্তন, অন্য উৎসের তেলের সাথে রাশিয়ান তেল মেশাতে ভিন্ন অঞ্চলের মজুদাগারে জ্বালানি তেল ও পরিশোধিত পণ্য পাঠানোর মতো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়াও অবলম্বন করা হতে পারে।
চলতি শীতে ইউরোপে জ্বালানি তেল সংকটের যেসব ভয়াবহতম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো এড়ানো গেছে। কয়েক মাস আগে জ্বালানি তেলের বাজার তেজি রাখার পেছনে ডিজেল ভূমিকা রাখলেও, ইউরোপে শীত কম পড়ায় এবং তার সাথে সেখানে পণ্যটির চালান বৃদ্ধির সুবাদে– পূর্বাভাসকে বাস্তব করে বিপর্যয় দেখা দেয়নি।
এর আগে রাশিয়ান ক্রুডে ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পর দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে এর দাম কমলেও, চালান পথ পাল্টে ভিন্ন দেশে যাচ্ছে।
মস্কোর নতুন ও বড় ক্রেতা হতে পারে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে, ইউরোপের নির্ভরতা বাড়বে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর, যেখানকার মহাকায় পরিশোধনাগারগুলো এরমধ্যেই বাড়তি চাহিদা পূরণ মাথায় রেখে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।
যদিও জ্বালানি পরামর্শক সংস্থা– এনার্জি অ্যাসপেক্টস লিমিটেড চলতি সপ্তাহে জানিয়েছে, রাশিয়া তার মোট ডিজেল রপ্তানির মাত্র এক-তৃতীয়াংশের জন্য নতুন ক্রেতা পাবে, বাকি অংশের উৎপাদন তাদের বন্ধ রাখতেই হবে।
এনার্জি অ্যাসপেক্টস- এর প্রধান তেলবাজার বিশ্লেষক অমৃতা সেন বলেন, 'জ্বালানি পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাটি বেশ জটিল, কারণ ইউরোপ ছাড়া অন্যত্র সেভাবে ডিজেল রপ্তানি করতে পারেনি রাশিয়া'।