ভালোবাসা দিবসকে ‘গরু আলিঙ্গন দিবস’ হিসেবে চালু করতে চেয়েছিল ভারত, যেভাবে বুমেরাং হলো
কয়েকশ বছর ধরেই ভারতের হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কাছে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে গরু।
গরু দেশটিতে এতটাই পূজিত একটি প্রাণী যে, সম্প্রতি ভারত সরকার ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসকে 'গরু আলিঙ্গন দিবস' হিসেবে পালন করার পরিকল্পনা করে।
কিন্তু তাদের এ ঘোষণা হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দেয়। ইন্টারনেটে রাজ্যের মিম, কার্টুন, এবং টেলিভিশন উপস্থাপকদের মাঝে এ নিয়ে কৌতুকের বন্যা বয়ে যায়।
গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এক বিবৃতিতে ভারতের অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার বোর্ড অব ইন্ডিয়া ভালোবাসা দিবসকে 'গরু আলিঙ্গন দিবস' হিসেবে পালনের আর্জি জানিয়েছিল।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতীয় সংস্কৃতি ও গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হচ্ছে গরু। ভারতে পশ্চিমা সংস্কৃতির জেরে বৈদিক সংস্কৃতি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে দাবি করে বৈদিক সংস্কৃতি চর্চার অংশ হিসেবে এ দিবস পালনের কারণকে ব্যাখ্যা করে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমালোচনা ও ব্যঙ্গোক্তির স্বীকার হওয়ার পর নাগরিকদের ওপর থেকে এমন আর্জি প্রত্যাহার করে নেয় ভারত সরকারের প্রতিষ্ঠানটি।
ভারতের অন্যতম শীর্ষ গণমাধ্যম এনডিটিভি'র একজন উপস্থাপককে দেখা যায় কয়েকটি গরুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে। এ সময় তিনি কৌতুক করে বলেন, 'সম্মতি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।'
'গোবিজ্ঞান'
গরু নিয়ে ভারত সরকারের নীতির জেরে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার নজির এটাই প্রথম নয়। ভারতের ৮০ ভাগ হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনেকেই গরু জবাই ও গোমাংস ভক্ষণকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করেন।
দেশটির অনেক স্থানেই গরু বিক্রি ও জবাই নিষিদ্ধ। ভারতের রাস্তাঘাটে গরুরা স্বাধীনচিত্তে ঘুরে বেড়ায়। এদেরকে বাঁচিয়ে চলতে বেগ পেতে হয় গাড়ি চালকদের।
ভারতের ফিশারিজ, অ্যানিমেল হাজবেন্ডারি ও ডেইরিং মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালে গরুকে রক্ষার জন্য 'রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ' (আরকেএ) নামক একটি সংস্থা স্থাপন করেছিল।
দু বছর পরে সমালোচনার মুখে 'গোবিজ্ঞান' নামক একটি পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করতে বাধ্য হয় সংস্থাটি। এ 'বিজ্ঞানে' গরুকে নিয়ে অবৈজ্ঞানিক কিছু দাবি তৈরি করেছিল আরকেএ।
বিভিন্ন অপ্রমাণিত দাবি নিয়ে ৫৪ পৃষ্ঠার একটি গাইড বইও তৈরি করেছিল সংস্থাটি। এসব দাবির মধ্যে একটি ছিল, বেশি গরু জবাই করলে বড়সড় ভূমিকম্প তৈরি হয় — কারণ গণহারে গোবধ এমন চাপ তৈরি করতে পারে যা ভূকম্পনের সূচনা করতে পর্যাপ্ত।
এছাড়া কোনো প্রমাণ না দেখিয়ে ওই বইয়ে আরও দাবি করা হয়েছিল, ভারতীয় গরু বিদেশি জাতের গরুর তুলনায় সর্বোত্তম মানের দুধ উৎপাদন করে।
রাজনৈতিক প্রাণী
২০১৪ সালে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে গরুর রাজনীতিকরণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শ রক্ষণশীল হিন্দু ঐতিহ্যগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সমালোচকেরা বলেন, মুসলমানদের ভয় প্রদর্শন, হয়রানি ও এমনকি হত্যা পর্যন্ত করার ক্ষেত্রে গো-আরাধনাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর তথ্যমতে, মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে গোভক্তদের অপরাধ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দিয়েছে।
২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারণায় মোদি 'গোলাপী বিপ্লব' বন্ধের শপথ করেন। গবাদিপশু জবাই বোঝাতে এ শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করা হয় দেশটিতে।
বিজেপির অনেক আইনপ্রণেতা এ বিষয়ে আরও এক কাঠি সরেস।
২০১৭ সালের মার্চ মাসে এক অনুষ্ঠানে ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের একজন আইনপ্রণেতা বলেছিলেন, কেউ গরুকে তাদের মা হিসেবে বিবেচনা না করলে এবং গরু জবাই করলে তিনি তাদের হাত-পা ভেঙে দেবেন।
এ বক্তব্যের পর দেশটিতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচকেরা মনে করেন, ভারতের সরকারের মধ্যে দ্বিচারিতা রয়েছে এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীগুলোর সুরক্ষা দিতে বিজেপি পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
বৃহস্পতিবার 'গরু আলিঙ্গন দিবস' বাতিল হওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিজেপির আইনপ্রণেতা গিরিরাজ সিং এটিকে সরকারের নেওয়া 'একটি খুব ভালো সিদ্ধান্ত' হিসেবে মন্তব্য করেন।
'গরুকে আলিঙ্গন করা প্রয়োজন,' তিনি বলেন। 'আমাদের উচিত গরুকে ভালোবাসা এবং এটিকে জড়িয়ে ধরা।'
সূত্র: সিএনএন