কঠিন প্রেম: ৭৫ বছরে ২৩বার বেইলআউটের জন্য আইএমএফের কাছে ছুটে গেছে পাকিস্তান
অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটাতে বার বার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শরণাপন্ন হচ্ছে পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি গত ৭৫ বছরে ২৩বার আইএমএফ- এর কাছে বেইল আউল প্যাকেজ সহায়তা নিয়েছে। এ যেন বৈশ্বিক দাতাসংস্থাটির 'কঠিন ভালোবাসার' প্রতি পাকিস্তানের 'আদি-অকৃত্রিম আসক্তির'-ই নমুনা। খবর ইকোনমিক টাইমসের
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মুর্তজা সায়্যিদ বলেন, 'বাস্তবতা হলো– আমরাই হলাম আইএমএফের সবচেয়ে নিয়মিত গ্রাহক'।
বেইল আউট হচ্ছে দেনার দায়ে বা মূলধনসংকটে পড়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তরফে আর্থিক সহায়তা করা। আর রাষ্ট্রগুলোকে এ ধরনের সহায়তা দেয় আইএমএফ।
পাকিস্তান এদিক দিয়ে শীর্ষে, আর ২১ বার বেইল আউট প্যাকেজ নেওয়ায় দ্বিতীয় স্থানটি আর্জেন্টিনার।
পাকিস্তানের গণমাধ্যম জিও নিউজকে সায়্যিদ তার দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের তুলনা দিয়ে বলেন, 'আমাদের সাথে একইসঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন করা ভারত মাত্র সাতবার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। আর ১৯৯১ সালে মনমোহন রাওয়ের উল্লেখযোগ্য সংস্কারের পর থেকে একবারও যায়নি'।
বিশ্ব অর্থনীতিতে আপৎকালীন সহায়তা দানকারী সংস্থার কাছে ৭৫ বছরের মধ্যে ২৩ বার হাত পাতা- একটি দেশ সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ার-ই উদাহরণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর আরো বলেন, 'আমাদের রিজার্ভে এখন ৩ বিলিয়ন ডলারেরও কম বৈদেশিক মুদ্রা আছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে মুদ্রার মজুত কখনও ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি। সে তুলনায়, বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ বিলিয়ন, ভারতের ৬০০ বিলিয়ন এবং চীনের প্রায় ৪ লাখ কোটি ডলারের রিজার্ভ রয়েছে। আর এদিকে ১৯৯০ এর দশক থেকে পাকিস্তান ১১টি আইএমএফ ঋণ সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে। বাংলাদেশ নিয়েছে তিনবার। এসময়ে চীন ও ভারতকে একবারও হাত পাততে হয়নি'।
করোনা মহামারির পর থেকেই গভীর সংকটে রয়েছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। এরমধ্যেই দেশটিতে ঘটেছে বিপর্যয়কর বন্যা। এতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে আরো বেড়েছে আমদানি চাহিদা। চড়া মূল্যস্ফীতি জনসাধারণের জন্য কোমরভাঙ্গা বোঝা হয়ে উঠেছে। খাড়া পতন হচ্ছে পাকিস্তানী রুপির বিনিময় মানে। বর্তমানে প্রায় দেউলিয়াত্তের কোঠায় নেমে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ। মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রকিংস ইনস্টিটিউটের জন্য লেখা নিবন্ধে এমন বর্ণনা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ মাদিহা আফজাল।
পাকিস্তানের এই দুর্দশা কয়েক বছর অন্তরই হচ্ছে। এর প্রধান কারণ, অর্থনীতির পর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতায় ঘাটতি এবং সে তুলনায় অত্যধিক ব্যয়। ফলে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে দেশটি। দিন দিন সে দেনার পরিমাণ যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বকেয়া কিস্তি। এতে আগের সংকটগুলোর চেয়ে পরেরগুলো আরো গুরুতর হয়ে উঠছে। যেমন পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক দেনা থাকার ঘটনা বর্তমান সংকট তৈরির পেছনেও ভূমিকা রেখেছে। তার সাথে 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেখা দেওয়া – খাদ্য ও জ্বালানির বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি।
মাদিহা আফজাল বলেছেন, এসব ঘটনার মিলিত প্রভাবে পাকিস্তান তার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পাকিস্তানের একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ সংস্থা টপলাইন সিকিউরিটিজের বরাতে জানিয়েছে, দেশটিকে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেনা পরিশোধের এই বড় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে না ইসলামাবাদ। আগামীতে দেশটিকে ঋণের চাপ কমাতে দেনা পুনর্গঠনের জন্য আলোচনা করতে হবে দাতাদের সাথে। ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পরিস্থিতিকে এক প্রকার রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্ত-ই বলা যায়, যেহেতু এ ক্ষেত্রে পুরোনো দেনার কিছু অংশ মওকুফ আর ঋণের কিস্তি পরিশোধের নতুন সময়সূচি নির্ধারণ করতে হয়।