কত দ্রুত রাশিয়া তার ট্যাংকবহর আগের জায়গায় নিয়ে যাবে?
আধুনিক যুদ্ধে ট্যাংক একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ যুদ্ধযানটি অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধেও দুই পক্ষই অনেক ট্যাংক ব্যবহার করছে। তবে রাশিয়া এ যুদ্ধে প্রচুরসংখ্যক ট্যাংক হারিয়েছে। আধুনিক ট্যাংকগুলো তৈরি করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। রাশিয়া চলমান যুদ্ধে কত দ্রুত এর ট্যাংকবহর পুনরায় গড়ে তুলতে পারবে, তা নিয়ে একটি ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী বিস্ময়কর হারে সোভিয়েত রাশিয়ার ট্যাংক ধ্বংস করেছিল। তবে ওই সময় রেড আর্মি ৮০,০০০ ট্যাংক হারালেও সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পখাতের অদম্য শক্তির দরুন যুদ্ধ শেষে দেশটির মোট ট্যাংকের সংখ্যা যুদ্ধ শুরুর সময়ের তুলনায় বেশি হয়ে দাঁড়ায়।
হাল আমলের ট্যাংকগুলো অনেক বেশি জটিল ও ব্যয়বহুল। এ কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে আগের মতো বড় সংখ্যায় ট্যাংক নামানো হয়না। তারপরও ইউক্রেনের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই — বিশাল সংখ্যায় ট্যাংক হারিয়েছে দেশটি।
ইউক্রেন রাশিয়ার ৩,২৫০টির বেশি ট্যাংক ধ্বংস করার দাবি করেছে। অরিক্স নামক একটি ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্লগের তথ্য অনুযায়ী, এ সংখ্যা ১,৭০০। দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ নামক একটি থিংক ট্যাংক জানিয়েছে, যুদ্ধের আগে থাকা রাশিয়ার টি-৭২ ট্যাংকবহরের প্রায় অর্ধেক ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়েছে।
রাশিয়ার টি-৭২ বহরে ট্যাংকের পরিমাণ ছিল প্রায় ২,০০০। দেশটির সামগ্রিক ট্যাংকবহরের বড় একটি অংশ ছিল টি-৭২ ট্যাংকগুলো।
এ যুদ্ধে রাশিয়ার ট্যাংকগুলো দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর পর্যাপ্ত পরিমাণ সহায়ক ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের শক্তি ছাড়া রাশিয়ান বাহিনী আরেকটি বড় আক্রমণ পরিচালনা করতে বিস্তর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এদিকে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেন এর পশ্চিমামিত্রদের কাছ থেকে ট্যাংক সংগ্রহ নিশ্চিত করেছে। খুব সম্ভবত সামনের বসন্তে পাল্টা আক্রমণ চালাতে এগুলো ব্যবহার করবে দেশটি। দখলিকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চল রাশিয়া যদি ধরে রাখতে চায়, তাহলে দেশটিকে এর ট্যাংকশক্তি বাড়াতে হবে। কিন্তু সোভিয়েতদের মতো এবারও কি রাশিয়া হারানো ট্যাংকের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে?
১৯৪০-এর দশকে সোভিয়েত কারখানাগুলো মাসে হাজারের বেশি ট্যাংক উৎপাদন করতে পারত। সে সময় যেসব কারখানা ট্রাক্টর ও রেলইঞ্জিন তৈরি করত, সেগুলোকেও ট্যাংক বানাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে উৎপাদন বাড়ানো রাশিয়ার পক্ষে কঠিন হবে।
ট্যাংকের নাইট ভিশন, কামানের লক্ষ্য ঠিক করা, ও অন্যান্য কাজের জন্য ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির দরকার হয়। আধুনিক ট্যাংকের ইলেকট্রনিক্স উচ্চমাত্রায় জটিল। এর ফলে এগুলো তৈরি করতে সময়ও লাগে বেশি। অর্থাৎ, যেসব কারখানা অন্য কোনো যন্ত্র তৈরি করে, সেগুলো এখন আর আগের মতো সহজেই ট্যাংক তৈরি করতে পারবে না।
রাশিয়ার এখন কেবল একটি ট্যাংক কারখানা টিকে আছে। ১৯৩০-এর দশকে তৈরি করা বৃহৎ এ কারখানাটির নাম উরালভ্যাগনজাভদ। কিন্তু আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও বিশাল দেনার কারণে এ কারখানার আধুনিকায়ন ধীরলয়ে হয়েছে।
কারখানাটির শ্রমিকেরা হাত দিয়ে ট্যাংক তৈরি করা নিয়ে কৌতুকও করেন। রাশিয়ায় উদারমনা সংবাদপত্র নোভায়া গ্যাজেটা'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ কারখানায় মাসে কেবল ২০টি ট্যাংক তৈরি হয়। দ্য ইকোনমিস্টকে একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্যাংকের উৎপাদনক্ষমতার তুলনায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর চাহিদা দশগুণ বেশি।
এ চাহিদা মেটানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে, রাশিয়া পুরোনো ট্যাংকের সংস্কারকাজে গতি এনেছে। আর দেশটির কাছে হাজার-হাজার পুরোনো ট্যাংক রয়েছে। ইউক্রেনে এখন টি-৯০-এর মতো আধুনিক ট্যাংকের পাশাপাশি কয়েক দশক আগে তৈরি করা বিশাল সংখ্যক টি-৭২বি৩ ট্যাংকও যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।
পুরোনো এ ট্যাংকগুলোর কামান আপগ্রেড করা হয়েছে, যোগ করা হয়েছে ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রিয়্যাক্টিভ আর্মার। এ ধরনের আর্মার শত্রুর গোলার ট্যাংকের শরীর ভেদ করার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
তবে এতসব আধুনিকায়ন সত্ত্বেও পুরোনো দিনের এসব ট্যাংক হাল আমলের ট্যাংকের তুলনায় অনেক দুর্বল। ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার সামনে এসব ট্যাংকের টিকে থাকার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু তারপরও এগুলো কাজের।
উরালভ্যাগনজাভদ মাসে আটটি ট্যাংক সংস্কার করতে পারে। এছাড়া আরও তিনটি রাশিয়ান সাঁজোয়া যান সংস্কার কারখানার প্রতিটি ১৭টি করে ট্যাংক সংস্কার করতে পারে বলে জানিয়েছে রাশিয়ান গণমাধ্যম। আগামী কয়েক মাসে একই আকারের আরও দুটি কারখানার কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে।
অর্থাৎ, সামনের দিনগুলোতে মাসে প্রায় ৯০টির মতো যুদ্ধক্ষম ট্যাংক সরবরাহ করতে পারবে রাশিয়া। তারপরও মাসে আনুমানিক ১৫০টি বিধ্বস্ত ট্যাংকের জায়গা নিতে এ সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ঘাটতির কারণেও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে রাশিয়া বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টরের অভাবে ভুগছে। আধুনিক ট্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে তৈরি কম্পিউটার চিপ।
ইউরোপীয় কমিশনের দাবি, রাশিয়া আমদানি করা ডিশওয়াশার ও রেফ্রিজারেটর থেকে সংগৃহীত চিপ সামরিক সরঞ্জামে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনে সংস্কারকৃত অনেক ট্যাংক জোড়াতালি দিয়ে পাঠিয়েছে রাশিয়া। এগুলোর হার্ডওয়্যার বিভিন্ন মডেল থেকে নেওয়া হয়েছে। এসব ট্যাংকে বায়ুর গতি পরিমাপক সেন্সরের মতো উচ্চ-প্রযুক্তির যন্ত্রাংশ নেই। এ উইন্ড-স্পিড মিটার যন্ত্র সঠিক লক্ষ্যে গোলা নিক্ষেপ করতে ব্যবহৃত হয়।
তবে এ সমস্যায় রাশিয়া একা নয়। ইউক্রেন এবং এর মিত্রদেশগুলোরও দ্রুতগতিতে ট্যাংক উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। যুদ্ধের শুরুর দিকেই খারকিভের কাছে ইউক্রেনের একমাত্র ট্যাংক কারখানাটি ধ্বংস হয়েছে। ইউক্রেনকে ৩১টি এম১এ২ আব্রামস ট্যাংক প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া আমেরিকার ট্যাংক কারখানা রয়েছে একটি। এ কারখানা মাসে ১৫টি ট্যাংক উৎপাদন করতে সক্ষম।
পশ্চিমাবিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও ট্যাংকের উৎপাদন হার একইরকম ধীর। তবে সাধারণত, আক্রমণকারী দেশ প্রতিরোধকারী দেশের তুলনায় বেশি সংখ্যক ট্যাংক ব্যবহার করে। এ যুদ্ধ চলতে থাকলে রাশিয়ার ট্যাংক বহর খুব সম্ভবত সংখ্যা ও মান উভয় দিক থেকে কমতে থাকবে। এবার আর উৎপাদন করে রক্ষা পাওয়া যাবে না।