বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং কেনা হচ্ছে টাকা দিয়ে! – জালিয়াতি বন্ধের অনুরোধ সৌদি একাডেমিকের
সৌদি আরবের বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি গবেষক, বিজ্ঞানীদের অর্থ দিচ্ছে গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠানকে 'কাগজেকলমে' দেখাতে। স্পেনের গণমাধ্যম এল পাইসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে থাকতে স্পেনীয় একাডেমিকদের টাকাপয়সা দিয়েছে সৌদির শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। খবর এল পাইসের
প্রতিবেদনটি পড়ে দারুণ মর্মাহত হন সৌদি রাসায়নিক প্রকৌশলী সাখের আলহুথালি। জেদ্দার কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক জালিয়াতির প্রক্রিয়া এবং কীভাবে এটি তার দেশের সৎ একাডেমিক ও নাগরিকদের মানহানি করছে – তার চিত্র তুলে ধরেন স্পেনের দৈনিক এল পাইসের কাছে।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'কিছু আরব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে গবেষকদের সম্পৃক্ত করার মানেই হলো- গোপনে ওইসব বিদেশি বিজ্ঞানীদের টাকাপয়সা দেওয়া, যাতে গবেষণাপত্রে তারা তাদের কাজের প্রধান জায়গা হিসেবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেন'।
অন্যান্য একাডেমিকদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত বা 'সাইটেশন' পাওয়া ৭,০০০ গবেষকের সম্মানসূচক তালিকা প্রকাশ করে ক্ল্যারিভেট। জালিয়াতির প্রক্রিয়ায় এই তালিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ক্ল্যারিভেট তালিকায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকর্মী বেশি- তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক একাডেমিক র্যাঙ্কিংয়ে (সাংহাই র্যাঙ্কিং নামেও যা পরিচিত) এগিয়ে থাকে।
এল পাইসের অনুসন্ধানে উঠে আসে যে, সৌদি আরবের সবচেয়ে পুরোনো দুটি বিশ্ববিদ্যালয় – কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় – সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত গবেষকদের এজন্য বছরে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ইউরো পর্যন্ত দিচ্ছে। অথচ, এরা বিশ্ববিদ্যালয় দুটির কর্মী নন, বরং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন।
এই ছলচাতুরির সহায়তায় সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয় দুটি বিশ্বের শীর্ষ ১৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উঠে আসে।
জেদ্দার স্থানীয় বাসিন্দা ৩৪ বছরের গবেষক সাখেরের মতে, 'এ ধরনের নিকৃষ্ট একাডেমিক বাঁদরামি বন্ধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে'।
পরামর্শক ফার্ম সিরিস একাডেমিক এর নতুন এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই জালিয়াতির বিপুল কলেবর। সিরিসের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পড়ে নিজস্ব অনুসন্ধান চালায় এল পাইস।
দেখা যায়, গত এক দশকে বিভিন্ন দেশের সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃতি পাওয়া ২১০ জন গবেষক সৌদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এদের বেশিরভাগই ছিলেন- চীন (৪৪ জন), স্পেন (১৯ জন), যুক্তরাষ্ট্র (১৬ জন), তুরস্ক (১৪ জন), ভারত (১৩ জন) এবং যুক্তরাজ্যের (১২ জন)। এছাড়া, ইতালি ও জার্মানি উভয়ের দেশের ১১ জন করে গবেষকও এমন ঘোষণা দিয়েছেন।
এল পাইসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এদিক থেকে স্পেনের গবেষকরা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। ক্ল্যারিভেটের ২০২২ সালের তালিকা বিশ্লেষণ করে জানায়, ওই বছর ১০ শতাংশ স্প্যানিশ গবেষক তাদের প্রাথমিক কর্মক্ষেত্র হিসেবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। সত্যতা যাচাইয়ের সময় এসব ব্যক্তি ও তাদের কর্মদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথেও কথা বলেছে এল পাইস।
অন্যদিকে, সিরিস একাডেমিকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কোনো দেশের সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত গবেষকদের মোট সংখ্যার তুলনায় এ ধরনের প্রতারণাকারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তুরস্কে (৪০ শতাংশ) এবং ভারতে (১২ শতাংশ)।
সাখের জানান, অধিক স্বীকৃত বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রের সহ-লেখক হিসেবে আরব গবেষকদের রাখতে হবে অনেক সময় এ শর্তে সৌদি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ দিয়ে থাকে। অথচ তথাকথিত এসব সহ-লেখকরা বলতে গেলে কিছুই করেন না।
সাখের চাইনিজ হ্যাম্পস্টার নামক ইঁদুরের এক প্রজাতির ডিম্বাশয় নিয়ে বায়োফার্মাসিউটিক্যালস উন্নয়নের গবেষণা করছেন। ক্ল্যারিভেটের ডেটাবেজে ভুল তথ্য দিয়েছেন, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারিতে এমন একজন স্পেনীয় বিজ্ঞানীর থেকে বার্তা পান তিনি। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ওই বিজ্ঞানী স্পেনেরই এক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার পরেও কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে (কেএইউ) তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বার্তায় তিনি সাখেরকে বলেন, "প্রিয় অধ্যাপক সাখের আলহুথালি, কেএইউ-তে আপনাকে আমার গবেষণা সহযোগী হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। তাই আমাদের মধ্যে যোগাযোগের সম্পর্ক থাকা দরকার। আমি যেমন আপনার কাজে সাহায্য করতে পারি, তেমনি আমার গবেষণায় আপনার কিছু লাইন জুড়েও দিতে পারি। আপনার নাম একাধিক গবেষণাপত্রে (সহ-লেখক) হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। দয়া করে এই সহযোগিতার ব্যাপারে আপনার মতামতসহ আমাকে বিস্তারিত জানিয়ে দেবেন।"
সাখের লন্ডনের বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল কলেজেও গবেষণা কাজে যুক্ত। এই বার্তা পেয়ে তিনি বেশ ক্ষুদ্ধ হন। তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হন যখন দেখেন, হঠাৎ করে কোনো বিদেশি বিজ্ঞানীর গবেষণাকাজে বিনা পরিশ্রমে সহ-লেখক হতে সৌদি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে উৎসাহিত করছে।
সঙ্গে সঙ্গে এই বার্তা কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের পাঠান সাখের। এবিষয়ে তিনি এল পাইসকে বলেন, "আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা কোনো গবেষণা সহযোগিতা নয়, বরং গর্হিত অন্যায়। বিস্মিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, এমন অসাধু উপায়ে আমাকে পদোন্নতি নিতে হবে?"
ক্ল্যারিভেট ডেটাবেজে ভুল তথ্য দিতে বিদেশি বিজ্ঞানীদের মাসে ৪,০০০ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া, গবেষণায় কোনো অবদান না রাখা সৌদি একাডেমিককে সহ-লেখক হিসেবে রাখলে আছে গবেষণাপত্র প্রকাশে বাড়তি আর্থিক সহায়তা। এক্ষেত্রে প্রথম সাড়ির জার্নালের 'আর্টিকেল প্রসেসিং চার্জ' (যা ২ থেকে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে) দেয় সৌদি বিশ্ববিদ্যালয়।
সাখের বলেন, "ফলে এই ধরনের সম্পৃক্ততা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বদলে বাজারি মুনাফা হয়ে ওঠে।
ডাচ বিজ্ঞানী ইয়ান-উইলিয়াম ভ্যান গ্রোনিন জানান, কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় আরো বেশি টাকার প্রস্তাব দেয়। ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর তিনি সৌদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একজন অধ্যাপকের থেকে একটি বার্তা পান। ক্ল্যারিভেট ডেটাবেজে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার বিনিময়ে বছরে গ্রোনিনকে ৭০ হাজার ডলার বেতন দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
গ্রোনিন বলেন, "উত্তর দেওয়ার রুচিও আমার হয়নি। কোনো বিজ্ঞানী যদি এমন প্রস্তাব গ্রহণ কর লে– তার সম্মানহানি হয়। এটা যেমন তার বদনামের কারণ হয়, তেমনি যে প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কর্মরত আছেন – তার প্রতিও অবিচার করা হয়।"
তিনি নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের একজন বিশেষজ্ঞ। গ্রোনিনের এক সহকর্মী কেন গিলারও এ ধরনের একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ক্ল্যারিভেটের ডেটাবেজে যেসব গবেষক কোনো সৌদি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের মূল কর্মস্থল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তাদের ৭৫ শতাংশই দ্বিতীয় কোনো দেশের প্রতিষ্ঠানকেও তাদের অপ্রধান কর্মস্থল হিসেবে উল্লেখ করেন। আসলে শেষোক্ত এসব প্রতিষ্ঠানই তাদের আসল কর্মস্থল।
সিরিস- এর প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন – সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ ও কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ সাইটেশন পাওয়া এমন গবেষকদের সম্পৃক্ততা খুবই বেশি; যথাক্রমে ৮১ ও ৮২ শতাংশ।
সাখের মনে করেন, 'সৌদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি গবেষণায় বেশি উদ্ধৃতি পাওয়া গবেষকদের সম্পৃক্ত করতে চায় – তাহলে তারা যাতে সত্যিই সৌদি আরবে আসতে উৎসাহী হন তেমন ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না করে, তাদের গবেষণাপত্রের সুযোগ নেওয়া অনুচিত'। গবেষণায় সম্পৃক্ততা সঠিকভাবে করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'ন্যায্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্পর্ক জ্ঞান-বিনিময়ের মাধ্যমে হওয়া দরকার'।