পারমাণবিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রে ফের বিতর্ক তুলেছে 'ওপেনহাইমার'! জাপানের জন্য যা আরও জটিল!
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ম্যানহাটন প্রজেক্টের অংশ হিসেবে চালায় পারমাণবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা। ইতিহাসে যা 'ট্রিনিটি টেস্ট' হিসেবে পরিচিত।
আর চলতি বছর ট্রিনিটি টেস্টের বর্ষপূর্তির কয়েকদিন পরেই মুক্তি পেয়েছে ঘটনাটির সাথে সংশ্লিষ্ট পারমাণবিক বোমার জনককে ঘিরে নির্মিত বায়োপিক সিনেমা 'ওপেনহাইমার'। গত ২১ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মুক্তি পেয়েছে ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত বহুল আলোচিত এ সিনেমাটি।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় কিন্তু 'ওপেনহাইমার' সিনেমাটি এখনো মুক্তি পায়নি। বরং আগামী ১৫ আগস্ট দেশটির স্বাধীনতা দিবসে সিনেমাটি মুক্তি পাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঠিক এই দিনটিতেই জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
একইভাবে জাপানেও কিন্তু 'ওপেনহাইমার' সিনেমাটি এখনো মুক্তি পায়নি। এমনকি দেশটিতে সিনেমাটি ঠিক কবে নাগাদ মুক্তি পাবে সেটিও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা।
এদিকে আগামী মাসেই হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পারমাণবিক বোমা 'লিটল বয়' ও ফ্যাটম্যান নিক্ষেপের ৭৮ বছর পূর্ণ হবে।
'ওপেনহাইমার' সিনেমাটির মুক্তিকে কেন্দ্র করেই যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একেক দেশে একেক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর যেন পুরনো বিতর্ক নতুন করে সামনে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জাপানে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা আসলেই যুদ্ধাপরাধ ছিল কি-না সেটি নিয়ে চলছে আলোচনা। অন্যদিকে 'ওপেনহাইমার' সিনেমাটিকে যে জাপানে একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বিষয়টি এমনও নয়।
যদিও ভারতসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে সিনেমাটি নানা কারণে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। তবে রাজনৈতিকভাবে অসংবেদনশীল দৃশ্য থাকার পরেও সিনেমাটি নিয়ে জাপানের পক্ষ থেকে তেমনভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি।
প্রতিক্রিয়া না দেখানো হলেও জাপানে এখনো মুক্তি পায়নি 'ওপেনহাইমার'। সিনেমাটির ডিস্ট্রিবিউটরেরা এখনো সঠিক সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ৬ ও ৯ আগস্টের পারমাণবিক হামলার বর্ষপূর্তির আয়োজনের পর যেকোনো সময়ে সিনেমাটি জাপানে মুক্তি দেওয়া হবে।
সাধারণত পারমাণবিক হামলার বর্ষপূর্তিগুলোতেও জাপানের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করা হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবস্থান নেওয়া হলেও নাগরিকদের মধ্যে রয়েছে আবার ভিন্নমত।
২০১৫ সালে জাপান ব্রডকাস্টিং কমিশন এনএইচকের এক পোলে দেখা যায়, শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিকট অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, হিরোশিমায় পরিচালিত পোলে দেখা যায়, ঐ অঞ্চলের শতকরা ৪৪ ভাগ মানুষও একইভাবে মনে করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
তবে এখন যদি জাপানে 'ওপেনহাইমার' মুক্তি দেওয়া হয়, তবে দেশটির নাগরিকেরা পারমাণবিক হামলা সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা করবে। এদিকে পরমাণু অস্ত্রের প্রতি জাপানের বর্তমান অবস্থানও বেশ অস্পষ্ট।
বর্তমানে জাপানের পক্ষ থেকে যদিও পারমাণবিক বোমার ব্যাপারে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা হয়। তবে একইসাথে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কোনো না কোনোভাবে দেশটির এর ওপর নির্ভর করতে হয়।
এদিকে সম্প্রতি জাপান প্রতিরক্ষা খাতে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। এমতবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে দেশটির অবস্থান ঠিক কী হবে সেটিই এখন বিবেচনার বিষয়।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে 'ওপেনহাইমার' সিনেমার প্রিমিয়ারের পর জাপানের কিওডো নিউজের পক্ষ থেকে হেডলাইন করা হয়, "মুক্তি পেল 'পারমাণবিক বোমার জনক'; তবে সেখানে নেই হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের চিত্রায়ন।"
শুধু জাপানে নয়, বরং খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারমাণবিক হামলা নিয়ে এমন মনোভাব প্রকাশ করা হয়। কিন্তু জাপানের নিজস্ব চিত্রায়ন নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক।
তবে ইতিহাসের পুরনো বিতর্ক নতুন করে সামনে না নিয়ে আসাটাই সম্ভবত দেশ দুটির জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হলেও জাপান পরবর্তীকালে যুদ্ধের বাস্তবতা অনেকটাই মেনে নিয়েছে।
সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, দেশটির রেকর্ড ৯০ ভাগ জনগণ শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান ইতিবাচক সম্পর্কের প্রশংসা করেছেন। অথচ চার দশক আগেও এই অবস্থান ছিল ভিন্ন।
গত বছর জাপানে বিদ্যমান পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্যমান তিন নীতির যৌক্তিকতা নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে। এই নীতির অধীনে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রের প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি কিংবা দেশে আমদানি নিষিদ্ধ।
২০২২ সালের শুরুর দিকে জাপানের প্রভাবশালী নেতা শিনজো আবে পরমাণু সম্পর্কিত আলোচনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে আবে ছিলেন ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র নেতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি তৃতীয়বারের মতো ফের দেশটির প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।
২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালালে তৎকালীন সময়ের এলডিপির পলিসি চিফ শোইচি নাকাগাওয়া জাপানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগিদ দেন।
নাকাগাওয়ার সেই বক্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আবে বলেন, "বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনাকে আমাদের 'ট্যাবু' হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়।"
এখন বিস্ময়কর মনে হলেও তৎকালীন সময়ে চীনের পরিবর্তে জাপানের সামরিকীকরণের বিপক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে বেশি শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এমনকি কয়েক বছর আগেও একই ধরণের মন্তব্য করায় জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি ভাইস-মিনিস্টার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
সময়ের সাথে সাথে জাপানে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সামরিকীকরণ প্রসঙ্গে বিতর্ক এখনো চলছে। যদিও পারমাণবিক অস্ত্রের ধারণাটি দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একইসাথে তিনি আজীবন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের মতাদর্শ প্রচার করে গিয়েছেন।
চলতি বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী কিশিদা গ্রুপ অফ সেভেনের নেতাদের সাথে হিরোশিমায় ভ্রমণ করে। এতে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন বিশ্ব তৈরির একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেক্রেটারি অফ ষ্টেট হেনরি কিসিঞ্জার গত মে মাসেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, জাপান আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশ হবে।
যদিও কিসিঞ্জারের এমন প্রতিক্রিয়া নতুন নয়। বরং কয়েক দশক ধরে তিনি জাপানের সামরিকীকরণ ঠেকাতে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে জাপানকে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ করায় কোনো পরিকল্পনা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিশিদার নেই। তবে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই বলে মনে করছেন অনেকেই।
পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রায়শই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। এমতবস্থায় জাপান নিজেদের অবস্থান তৈরিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে ঠিক কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই ভাববার বিষয়।
অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী অনেক অনুমানকেই ভুল প্রমাণিত করছে। এছাড়া তাইওয়ান ইস্যুতেও বাড়ছে উত্তেজনা। এমতবস্থায় পরমাণু অস্ত্রের বিষয়ে জাপান নতুন করে ভাবতে পারে।
'ওপেনহাইমার' সিনেমাটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু অস্ত্রের কাছে জাপানের অসহায় আত্মসমর্পণের বিষয়টি ফের তুলে ধরা হয়েছে। তাই দেশটির দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি দেখার সুযোগ পেলে তা পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে জাপানের বহু বছরের আলোচনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে।