ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত- স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে পশ্চিমারা
পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বহুল প্রত্যাশিত ইউক্রেনের পাল্টা-আক্রমণ অভিযান শুরুর পর কেটে গেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ। এই সময়ে রণাঙ্গনের পরিস্থিতি সম্পর্কে 'আশঙ্কাজনক' বিশ্লেষণই জানাচ্ছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। বিশেষত, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমি উদ্ধারে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সামর্থ্য নিয়েও তারা সন্দিহান।
যুদ্ধ সম্পর্কে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন'কে এমন কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের চারজন সিনিয়র কর্মকর্তা।
শীর্ষ একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, 'অগ্রগতির কোনো সুযোগ আছে কিনা– আগামী আরো কয়েক সপ্তাহ সেটা (ইউক্রেন) তারা দেখবে। কিন্তু, এই সংঘাতের ভারসাম্য বদলে দেওয়ার মতো উন্নতি তাদের পক্ষে করাটা খুবই অসম্ভব বলে মনে করছি।'
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান মাইক কুইগলে সম্প্রতি ইউরোপ সফর সম্পন্ন করেন। সফরকালে তিনি ইউক্রেনীয় বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে যুক্ত মার্কিন সেনা কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করেন।
সফরকালে হওয়া আলোচনার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'ব্রিফিংয়ে আমাদের যা বলা হচ্ছে তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তাদের সামনে থাকা (মারাত্মক) প্রতিকূলতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটাই এ যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন সময়।'
রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে তাদের দখলকৃত এলাকায় বহুস্তর-বিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেছে। লাখ লাখ স্থলমাইনের সাথে যেখানে রয়েছে সারি সারি পরিখার জাল।
এই প্রতিরোধ ভেঙ্গে এগুতে গিয়ে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ইউক্রেনীয় সেনারা। ফলে বাধ্য হয়েই সেনাদের পিছু হঠার নির্দেশ দিয়ে, পুনরায় সংগঠিত করতে হয়েছে কমান্ডারদের।
এই বাধা পেরোনোই বর্তমানে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জ্যেষ্ঠ আরেক পশ্চিমা কূটনীতিক সিএনএনকে বলেন, 'রুশদের বেশকিছু প্রতিরক্ষা সারি রয়েছে, অথচ ইউক্রেনীয়রা প্রথম সারিই ভেদ করতে পারেনি। গত সাত, আট সপ্তাহ লড়াই করেও তারা যে প্রতিরোধ ভাঙ্গতে পারেনি, সেটা আরো কয়েক সপ্তাহ যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও হঠাৎ করেই পারবে– সেই সম্ভাবনা কোথায়? বিশেষ করে, এই সময়ে তাদের জনবল তো আরো কমবেই। কারণ, পরিস্থিতি খুবই কঠিন।'
সিনিয়র একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেনীয় বাহিনী যে প্রতিকূলতার মধ্যে আছে, যুক্তরাষ্ট্র সেটা স্বীকার করে। তবে আমরা নতুন অগ্রগতি হওয়ার আশাও রাখি।
তিনি বলেন, 'আমরা জানি, এমন অবস্থায় এগুনো কষ্টসাধ্য- অভিযানের গতিও প্রত্যাশার চেয়ে বেশ কম। তবে আমি মনে করি, এখনও তাদের উন্নতি করার মতোন সময় ও সুযোগ আছে।'
স্তেপ ভূমিতে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে সামনেই আসছে শরৎকাল। এসময়ে আবহাওয়ার কারণে লড়াই চালিয়ে আরো কষ্টকর হবে। ফলে অগ্রগতি করতে হলে খুব দ্রুতই তা করতে হবে ইউক্রেনীয়দের। নাহলে হাতে সময় খুবই কম বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন একাধিক মার্কিন কর্মকর্তা।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, সাঁজোয়া বাহিনী ও পদাতিক সেনার সমন্বয়ে একটি বাহিনী কম্বাইন্ড মেকানাইজড সক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু, অগ্রগতির বেহাল দশা প্রমাণ করছে, স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইউক্রেনীয়দের এমন ইউনিটে রুপান্তর করা সম্ভব হয়নি। কিছুক্ষেত্রে পশ্চিমা ট্যাংক ও অন্যান্য অস্ত্র পরিচালনায় মাত্র ৮ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধের ময়দানে সাফল্যের অভাবেই রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার পরিমাণ বাড়িয়েছে ইউক্রেনীয়রা। এর মাধ্যমে 'তারা রাশিয়ার দুর্বলতা বাকি বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাইছে' বলে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ এক মার্কিন কর্মকর্তা।
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলে'কে বলেছেন, পর্যায়ক্রমে সামনে এগোনোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা এখনও দৃঢ় রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই জেনারেলকে জানান তিনি।
জালুঝনি বলেন, 'আমাদের সেনারা তাদের সেরাটা দিচ্ছে। শত্রু একাধিক দিক দিয়ে আক্রমণ করেও সফল হতে পারছে না।'
ইউক্রেনীয় সরকার এই কথোপকথনের একটি ধারাভাষ্য প্রকাশ করেছে।
দক্ষিণাঞ্চলে অভিযানে থমকে গেছে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রগতি, সেখানকার পরিস্থিতির প্রসঙ্গে মার্ক মিলেকে জালুঝনি বলেন, 'প্রচণ্ড লড়াই চলছে, এরমধ্যে আমাদের সেনারা ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করছে। প্রথম পদক্ষেপ আমরাই নিতে পারব।'
এক কথায় বলতে গেলে, যুদ্ধে এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করেছেন ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান। পাল্টা-আক্রমণ নিয়ে কিয়েভের কর্মকর্তারা শুরুতে যে আশাবাদ প্রকাশ করে আসছিলেন– সাম্প্রতিক বিশ্লেষণগুলোয় তা যেন তা বালির প্রাসাদের মতো ভেঙে পড়েছে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা এখন বলছেন, এমন আশাবাদ ছিল 'অবাস্তব' – আর এটা উপলদ্ধি করে, পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক রাজনীতিবিদ শান্তি আলোচনা শুরু করতে ইউক্রেনকে চাপ দিচ্ছেন। এমনকী শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে নিজ ভূখণ্ডের কিছু অংশ ছেড়ে দিতেও বলা হচ্ছে।
কংগ্রেসম্যান মাইক কুইগলে বলেন, 'পুতিন ঠিক এ ধরনের কিছুর জন্যই অপেক্ষা করছেন। সেনাদের মৃত্যুর মুখে উৎসর্গ করে কালক্ষেপণ করার সুযোগ রয়েছে তার।'
পাল্টা-আক্রমণ নিয়ে বিপুল প্রত্যাশার সাথে প্রকৃত বাস্তবতার এ ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে। এনিয়ে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা ও তাদের পশ্চিমা সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের ঘটনা শুরু হতে পারে। এতে মিত্র-জোটে বিভাজন দেখা দেবে।
জ্যেষ্ঠ একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, 'পাল্টাপাল্টি দোষারোপের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, এটাই বড় সমস্যা। তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।'
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসপেন সিকিউরিটি ফোরামে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি। এসময় তিনি বলেছিলেন, পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সহায়তা আসতে দেরি হওয়ায় ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা বসন্তে পাল্টা-আক্রমণ শুরুর পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু তা করতে পারিনি। স্পষ্টভাবে বললে, আমাদের কাছে যথেষ্ট গোলাবারুদ, অস্ত্র ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্রিগেড ছিল না।'