চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয়ের পথে ভারত? স্বল্প খরচেও ‘সফলতার’ রহস্য কী?
চাঁদে রাশিয়ার পাঠানো মহাকাশযান বিধ্বস্ত হওয়ায় পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে চন্দ্রযান অবতরণ করানো প্রথম দেশ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে ভারতের।
রবিবার (২০ আগস্ট) ভারতের মহাকাশ সংস্থা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন (ইসরো) জানায়, তাদের মহাকাশযানের গতি সফলভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে এবং ২৩ আগস্ট অবতরণের চেষ্টার আগে এই চ্যালেঞ্জিং জায়গায় সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করা হবে।
চাঁদের এই অংশে পানির অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস বিজ্ঞানীদের। সেখানে মানুষ বসবাসের উপযোগী পরিবেশ থাকতে পারে বলেও ধারণা। ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়া, ইসরায়েল এবং ইউরোপিয় মহাকাশ সংস্থাও দক্ষিণ মেরুতে অভিযান চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রথম দেশ হিসেবে ভারতের 'সফলতা' দেশটিতে মহাকাশ গবেষণায় শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে।
ভারতও তাদের প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিল। চন্দ্রযান-৩ অভিযান অবতরণে তাদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। ভারতের রকেট উৎক্ষেপণের পর জানা যায়, রাশিয়াও দক্ষিণ মেরুতে অভিযান চালাতে যাচ্ছে। ১১ আগস্ট ল্যান্ডার নিয়ে তাদের লুনা-২৫ রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ছিল ৪৭ বছর পর রাশিয়ার প্রথম চন্দ্রাভিযান। ভারতের আগেই, ২১ আগস্ট রুশ মহাকাশযান দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করানোর প্রত্যাশা করা হয়েছিল। তবে রবিবার (২০) আগস্ট জানা যায়, যানটি বিধ্বস্ত হয়েছে।
ইসরো কর্মকর্তারা রাশিয়ার ব্যর্থতা নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন। এক কর্মকর্তা জানান, আমরা চাঁদে একই সঙ্গে দুই মহাকাশযানের সাক্ষাতের আশা করেছিলাম।
এই অভিযান সফল হলে মহাকাশ গবেষণার এক অভিজাত শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হবে ভারত। যুক্তরাষ্ট, রাশিয়া ও চীনের পর চাঁদে অবতরণ করা চতুর্থ দেশ হবে ভারত। সর্বশেষ ২০১৯ সালে চীনের চ্যাং-৪ চন্দ্রযান চাঁদ স্পর্শ করে।
অথচ মহাকাশ গবেষণায় ভারতে বরাদ্দকৃত অর্থ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র বলা যায়। সর্বশেষ বাজেটে, মহাকাশ বিভাগে ভারতের বরাদ্দ ছিল ১.৫ বিলিয়ন ডলার। এতে ইসরো-সহ বাকি সবকিছুর ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার।
কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির মহাকাশ আইন বিষয়ের অধ্যাপক রাম যাখু বলেন, চন্দ্রযান-৩ ভারতকে অন্য দেশের সাথে মিলে মহাকাশ গবেষণার সুযোগ দেবে। বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ যারা মহাকাশ গবেষণায় অংশ নিতে চায় তাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে।
যাখু বলেন, যখন আপনি সফল হবেন তখন সবাই আপনার কাছে আসবে। অন্যদেশগুলো ভারতের কাছে জানতে চাইবে, কীভাবে কম খরচে মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করা যায়।
ভারতের চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণ করা হয় গত ১৪ জুলাই। চাঁদে অবতরণে যানটির সময় লাগছে প্রায় ৪০দিন। যা রাশিয়ার তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি। কারণ ভারতের যানটির ওজন বেশি। একই সাথে রাশিয়ার লুনা-২৫ এর তুলনায় জ্বালানির পরিমাণও ছিল কম। ভারত তাদের চন্দ্রযানকে পৃথিবী এবং চাঁদের এমন রুটে পাঠায়, যেখানে মাধ্যাকর্ষণের সুবিধা নিয়ে কম জ্বালানি খরচ করে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্য দেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমেও আয় করছে ইসরো। যদিও এই মার্কেটে আধিপত্য বজায় রাখা ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের তুলনায় তার পরিমাণ অতি ক্ষুদ্র। তবে ভারতও তার বেসরকারি মহাকাশ শিল্প বিকাশের চেষ্টা করছে।
ভারতের মহাকাশ খাতে বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করা ভিশেষ রাজারাম বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে মহাকাশ অর্থনীতিতে ভারতের অবদান থাকবে ৯ শতাংশ। যা বর্তমানে ২ শতাংশ।
২০২২ সালের নভেম্বরে ভারতের স্টার্টআপ স্কাইরুট অ্যারোস্পেস দেশের প্রথম বেসরকারি রকেট উৎক্ষেপণ করে।
মহাকাশ গবেষণা নিয়ে বিভক্তির মধ্যেই ভারত ও রাশিয়া চাঁদে অভিযান চালাচ্ছে। মহাকাশ অভিযানে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সাথে সহমত। অন্যদিকে রাশিয়া চাইছে চীনের সঙ্গে মিলে চাঁদ গবেষণায় এগিয়ে যেতে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার মহাকাশ সংস্থা নাসাকে চীনের সঙ্গে মিলে মহাকাশ গবেষণায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে নভোচারী সমেত চাঁদের চারপাশ ঘুরবে এমন চন্দ্রাভিযান পরিচালনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অন্যদিকে চীন ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে নভোচারী অবতরণের লক্ষ্য নিয়েছে।
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে দক্ষিণ মেরু নিয়ে আগ্রহ বাড়ার কারণ, ২০১৮ সালে নাসার সরঞ্জাম ব্যবহার করে পরিচালিত ভারতের প্রথম চন্দ্রাভিযানে (তখন অবতরণের চেষ্টা হয়নি) এই অংশে বরফের অস্তিত্বের দাবি করা হয়। তবে এই্ অংশে নিরাপদ অবতরণ কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থার প্রধান আলেক্সান্ডার বলেন, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফল অবতরণের সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ।
জাপান ও ইসরায়েলও দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান অবতরণের চেষ্টা করে। তবে দুই দেশই ব্যর্থ হয়। ২০১৯ সালে দক্ষিণ মেরুতে ভারতের প্রথম চন্দ্রযান অবতরণে ব্যর্থতার জন্য সফ্টওয়্যারে ত্রুটির কথা বলা হয়।
ইসরোর বর্তমান চেয়ারম্যান এস. সোমানাথ বলেন, এবার উন্নত সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। একটি সফ্টওয়্যার ব্যর্থ হলে তার বিকল্পও রাখা হয়েছে। চন্দ্রযান-৩ এর রোভারের 'পা' গুলো মজবুত, জ্বালানির ট্যাংক বড় এবং অধিক সোলার প্যানেলযুক্ত।
যদি অবতরণ সম্ভব হয়, তাহলে রোভারটি খনিজ মজুতসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে গবেষণা চালাবে।