কী ক্ষমা করা অসম্ভব? ২০১৮ সালে পুতিনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কী জবাব ছিল তার...
ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্তের পর অনেকেই ঘটনাটির পেছনে পুতিনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছেন। কেননা জুন মাসেই তার নেতৃত্বেই পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহ করেছিল ওয়াগনার গ্রুপ।
এরই মাঝে ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক ডকুমেন্টরিতে পুতিনের এক সাক্ষাৎকার নেটদুনিয়ায় ফের ছড়িয়ে পরেছে। সেখানে মূলত সাংবাদিক ক্ষমা করার প্রসঙ্গে পুতিনের কাছে জানতে চায়।
সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক আন্দ্রেই কনড্রশভ পুতিনকে জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি কি মানুষের ভুল ক্ষমা করতে পারেন?" জবাবে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, "হ্যাঁ, পারি। তবে সব ভুল ক্ষমা করতে পারি না।"
তখন সাংবাদিক আন্দ্রেই জানতে চান, "এমন কোন ভুল রয়েছে যা আপনার পক্ষে ক্ষমা করা অসম্ভব?" জবাবে সাবেক কেজিবি অফিসার পুতিন বলেন, "বিশ্বাসঘাতকতা।"
একটা দীর্ঘ সময় পুতিনের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন প্রিগোজিন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে ওয়াগনার গ্রুপ অংশ নেওয়ার পরেই শুরু হয় টানাপোড়েন।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই অস্ত্র সরবরাহে ঘাটতির অভিযোগ তুলে রাশিয়ার সামরিক নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন ওয়াগনার বস প্রিগোজিন। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক-প্রধানের সঙ্গেও প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তারই চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে গত জুনে একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
বিদ্রোহের ব্যর্থ হওয়ায় পর অনেকেই ভেবেছিলেন যে, প্রিগোজিনকে হয়তো গ্রেফতার, গুম কিংবা হত্যা করা হবে। তবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেটি না করে বরং বিদ্রোহ করা সৈন্য ও ওয়াগনার বসকে প্রতিবেশী দেশ বেলারুশে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন পুতিন।
বেলারুশের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো মধ্যস্থতায় সমঝোতা যেটাই হোক না কেন; বিশ্লেষকেরা প্রিগোজিনের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে বলে বিদ্রোহের পর থেকেই অনুমান করছিলেন। তবে ওয়াগনার বস যেন সেটিকে হয়তো খুব বেশি আমলে নেননি। কেননা এরপরেও রাশিয়ায় যাতায়াত করেছেন তিনি।
গত মাসে সেন্ট পিটার্সবার্গে আফ্রিকা-রাশিয়া সামিটে প্রিগোজিনকে দেখা গিয়েছিল। সেখানে সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকের প্রেসিডেন্সিয়াল উপদেষ্টা ও অ্যাম্বাসেডর ফ্রেডি মাপুকার সাথে ওয়াগনার বসের হ্যান্ডশেক করা ছবিও প্রকাশিত হয়।
তবে পুতিনের বিরুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপের ব্যর্থ বিদ্রোহের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও প্রিগোজিনকে সতর্ক করা হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও আন্দাজ করেছিলেন যে, ওয়াগনার বসকে হত্যা করা হতে পারে।
সিআইএ ডিরেক্টর বিল বার্নস ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন মন্তব্য করেছিলেন যে, প্রিগজিনের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
গত জুলাই মাসে ব্লিংকেন বলেছিলেন যে, "আমি যদি প্রিগোজিনের জায়গায় থাকতাম, তবে আমি নিজেকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকতাম।"
গত বুধবার প্রিগোজিনকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্তের সংবাদটি ছড়িয়ে পরলে কিছু মার্কিন কর্মকর্তা একেবারেই আশ্চর্য হননি। বরং একজন কর্মকর্তা বলেন, "আমরা সকলেই এতদিন জানতাম যে, প্রিগোজিন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে চলাচল করছেন।"
ব্রিটিশ-আমেরিকান ব্যবসায়ী বিল ব্রাউডার একসময় রাশিয়াতে অন্যতম বিদেশি বিনিয়োগকারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নিজেকে পুতিনের তীব্র সমালোচক হিসেবে উপস্থাপন করেন।
বিল ব্রাউডার বলেন, "পুতিন কখনো ক্ষমা করেন না; কখনো ভুলেও যান না। প্রিগোজিনের বিদ্রোহ পুতিনকে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করেছে। রুশ প্রেসিডেন্টের কাছে এটা সবচেয়ে বড় অপরাধ।"
অন্যদিকে বিমানটি বিধ্বস্তের ঘটনায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে ঘটনার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল (বৃহস্পতিবার) টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে প্রিগোজিনকে নিয়ে নিরবতা ভাঙেন পুতিন।
বিমানটি বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন পুতিন। তবে বিমানের যাত্রী হিসেবে তালিকাভুক্ত ওয়াগনার বস প্রিগোজিন মারা গেছেন কি-না, সেটি নিশ্চিত করে কিংবা সরাসরিভাবে কিছু বলেননি তিনি।
বক্তব্যে পুতিন বলেন, "বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি বেশ হৃদয়বিদারক। প্রাথমিক তথ্যগুলো ইঙ্গিত করে যে, ওয়াগনার সেনারা বিমানটিতে ছিল। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, এই ওয়াগনার সেনারাই ইউক্রেনের নব্য-নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষে লড়াই করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। আমরা সেগুলো জানি এবং তাদের এ প্রতিদান আমরা কখনও ভুলবো না।"
রাশিয়ার কয়েকটি আউটলেটের মতে, বিধ্বস্ত বিমানটি এমব্রেয়ার লিগ্যাসি ৬০০ মডেলের। বিমানটির টেইল নম্বর ছিল আরএ-০২৭৯৫; যেটি প্রিগোজিন নিজে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।
পুতিন বলেন, "আমি প্রিগোজিনকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম; প্রায় ৯০ এর দশকের শুরু থেকে। জটিলতায় ভরা ভাগ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। তবে জীবনে তিনি গুরুতর কিছু ভুলও করেছিলেন।"
পুতিন আরও বলেন, "প্রিগোজিন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি, একজন প্রতিভাবান ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি কেবল আমাদের দেশেই সফলতার সাথে কাজ করেননি। পাশাপাশি বিদেশেও, বিশেষ করে আফ্রিকাতে তার কাজের পরিধি বিস্তৃত ছিল। সেখানে তিনি তেল, গ্যাস, মূল্যবান ধাতু ও পাথরের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।"
লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজের কেয়ার গাইলস জানান, প্রিগোজিনের মৃত্যুর সংবাদকে ঘিরে সকলকে 'বিশাল সতর্কতা' অবলম্বন করতে হবে।
কেয়ার গাইলস বলেন, "ঘোষণা করা হয়েছে যে, ইয়েভগেনি প্রিগোজিন নামে একজন যাত্রী বিধ্বস্ত বিমানটিতে ছিলেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, একাধিক ব্যক্তি ভ্রমণের তথ্য লুকাতে নিজেদের নামের পরিবর্তে ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের নাম ব্যবহার করে থাকেন।"
পুতিন বলেন, "আমি যতদূর জানি, প্রিগোজিন গতকাল আফ্রিকা থেকে ফিরেছিলেন। তিনি এখানে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। ইতিমধ্যে এই ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তটি সফলভাবে সম্পন্ন করা হবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেখা যাক, তদন্তে কী উঠে আসে।"
কেয়ার গাইলস মনে করেন, যতক্ষণ না 'নিশ্চিতভাবে' জানা যাবে যে, বিমান বিধ্বস্তে নিহত ব্যক্তিটিই আসল প্রিগোজিন, ততক্ষণ যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে আফ্রিকা থেকে নতুন করে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে প্রিগোজিনকে জীবিত দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পুতিন বলেন, "অদূর ভবিষ্যতে তদন্তকারীরা কী বলে, সেটাই দেখার বিষয়। এখন বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, টেকনিক্যাল যাচাই-বাছাই ও জেনেটিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে কিছু সময় লাগবে।"
অন্যদিকে বিল ব্রাউডার বলেন, "পুতিন তার বিরোধীদের এমনভাবে হত্যা করতে পছন্দ করেন যাতে সেটি অস্বীকার করা যায়। একইসাথে তিনি যাতে তদন্তের কথা বলতে পারেন। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম ঠিক কী হতে পারে, সেই বার্তাই সকলকে প্রদান করেন।"