ভূমিকম্পের আগে মরক্কোর আকাশে উজ্জ্বল আলোর ছটা, ‘বিজ্ঞান-সম্মত’ ঘটনা!
গত শুক্রবার রাতে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে। এতে দেশটির দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম শহর মারাকেশ-সহ বেশকিছু এলাকা ধবংসস্তূপে পরিণত হয়। নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৬০০ জনেরও বেশি বলে সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে। আহত আরও হাজার হাজার মানুষ।
শুক্রবার রাতে মারাত্মক এ দুর্যোগ আঘাত হানার কিছু সময় আগে দেশটির আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানির মতোন অদ্ভুত আলোকছটা দেখা যায়। দেশটির সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকেই এ দৃশ্য দেখার কথা জানান তাদের পোস্টে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ছবির সত্যতা নিরূপণ করা কঠিন হলেও, বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্প আঘাত হানার আগে তা বায়ুমণ্ডলে নানান রকম আলোকছটা তৈরি করতে পারে। এ ঘটনা – মাটির নিচে বৈদ্যুতিক প্রবাহে পরিবর্তনের কারণেই হয়।
ভূ-পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিডম্যান ফ্রন্ড বলেন, 'মরক্কোতে রাতের বেলায় ভূমিকম্প হয়েছিল। তাই ভূমিকম্পের উৎপন্ন আলো দেখতে পাওয়া বা সে দৃশ্য অনেকের ক্যামেরায় ধারণ করার ঘটনা– স্বাভাবিকভাবেই হয়ে থাকতে পারে।'
ভূমিকম্পের কারণে নানান রকম আলো বিচ্ছুরণ হতে পারে। এরমধ্যে মেঘের আড়ালে বিজলীর মতো আলোর ঝলকানি দেখতে পাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি ঘটে। তবে ঝড়ের সময় আকাশ যেভাবে বজ্রের ঝলকানি দেখা যায়– এটা তেমন নয়।
ফ্রিডম্যান জানান, ভূমিকম্পের বিদ্যুৎ তরঙ্গ মাটি থেকে মেঘের দিকে ওঠে। পৃথিবীর অভ্যন্তরের ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়াকালাপের ফলেই এসব বৈদ্যুতিক চার্জ সক্রিয় হয়। পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়ার ফলেই ভূকম্পনের আলো সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার তথ্যমতে, এই আলোর ছটা অনেক সময় স্থির উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে পারে। কখনোবা আলোর গোলক আকারে, কখনোবা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো হতে পারে।
ফ্রিডম্যান ব্যাখ্যা করেন যে, আমাদের পৃথিবী বিদ্যুৎ পরিবাহী। ভূমিকম্পের সময় মাটির নিচের শিলাস্তর ও খনিজগুলো অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন ভূপৃষ্ঠের ফাটল দিয়ে বিদ্যুৎশক্তি বেড়িয়ে আসে। বৈদ্যুতিক চার্জ ভূপৃষ্ঠের কাছে অনেক বেশি পরিমাণে জমা হলে– একপর্যায়ে তার বিচ্ছুরণ ঘটে। কারণ, শিলাস্তরের পজিটিভ চার্জকে আকৃষ্ট করে পৃথিবীর উচ্চ বায়ুমণ্ডলে থাকা নেগেটিভ চার্জের সূক্ষ্মকণা। এ দুই ধরনের চার্জ যখন মিলিত হয়, তখনই তা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়।
তার মতে, দিনের বেলাতে ভূমিকম্পের আলো তৈরি হয়– তবে সেটা সূর্যালোকের কারণে বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় না। 'কিন্তু, রাতে হলে আলো ভালোভাবেই দেখা যায়, এমনকি অদ্ভুত এই আলো নিয়ে তখন সংবাদও প্রচারিত হয়।' মরক্কোর বেলায় তাই–ই ঘটেছে বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ।
এই আলোর রঙ নির্ভর করে বায়ুমণ্ডলে কোন ধরনের কণা ভূপৃষ্ঠের চার্জে আকৃষ্ট হয়েছে তার ওপর। অক্সিজেনের কণা হলে– আলোর রঙ লাল বা সবুজাভ হতে পারে। আবার এ দুয়ের সংমিশ্রণে উজ্জ্বল হলুদ আলোর ঝলকানি দেখাও বিচিত্র নয়।
ফ্রিডম্যান জানান, ভূপৃষ্ঠ ও আকাশে বৈদ্যুতিক চার্জের পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় মানুষ বা পশুপাখির মাথাব্যথার মতো অনুভূতি হতে পারে। ভূমিকম্পের আগে কিছু প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণের এটিও একটি ব্যাখ্যা। বৈদ্যুতিক চার্জের ঘটনা মানুষ অন্যভাবেও অনুভব করে। অনেক সময় এই চার্জের কারণে আমাদের চুল খাড়া হতে পারে, বা ত্বকে সুরসুরির মতো অনুভূতি হতে পারে।
ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষায় দেখা গেছে, কোনো বস্তুকে সেভাবে প্রচণ্ড চাপ দিলে– সেটিতে ফাটল ধরার সময় সেখান থেকে বৈদ্যুতিক চার্জ হিসেবে শক্তি নিঃসৃত হয়। ঠিক যেমনটা হয় ভূমিকম্পের সময়।
তিন দশক ধরে নাসায় ভূমিকম্প ও তার আলো নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী ফ্রিডম্যান বলেন, 'ভূমিকম্পের আলো দেখা গেছে, বুঝতে হবে মাটির নিচে চাপের পরিমাণ বাড়ছে, এবং একসময় তা থেকে ভূমিকম্প আঘাত হানবে। তবে আলো দেখার পর ভূমিকম্প যে হবেই– তার কোনো নিশ্চিয়তা নেই।'