ইতিহাস কীভাবে বদলে যায়! কোরিয়া এখন অস্ত্র সরবরাহকারীর ভূমিকায়
কয়েক দশক আগে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় যুদ্ধের সময় কোরিয়ান উপদ্বীপে অস্ত্র ও সহায়তার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল ওয়াশিংটন ও মস্কো। আজ এ সময়ে এসে ইতিহাস যেন উল্টো হয়ে দেখা দিচ্ছে — রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এখন দুই কোরিয়ার কাছে গোলাবারুদের জন্য 'হাত পাতছে'।
উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া উভয় দেশেরই যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী একক স্বার্থ রয়েছে। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন রাশিয়া সফর করে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে দুই নেতা 'আশু সহযোগিতা বিষয়ে সন্তোষজনক মতৈক্যে' পৌঁছেছেন বলে জানা গেছে।
মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো অস্ত্রচুক্তি হলেও তা কোনো পক্ষই প্রকাশ করেনি, করার কথাও নয়। কারণ উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র কেনা বা দেশটির অস্ত্র প্রোগ্রামের জন্য সহায়তা প্রদান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার বিরোধী। খোদ রাশিয়া ওই প্রস্তাবনায় ভোট দিয়েছিল।
ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বৈঠকটিতে 'কিম জং উনের কাছে পুতিনের সাহায্যভিক্ষা' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কোরিয়ান উপদ্বীপের দিকে সাহায্যের জন্য এখন কেবল রাশিয়াই নজর দিচ্ছে না।
ওয়াশিংটনের সঙ্গে নীরবে হওয়া এক চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে জাহাজে করে বিপুল পরিমাণে আর্টিলারি গোলা পাঠাচ্ছে। দেশটির দাবি, এটি ইউক্রেনকে কোনো প্রাণহানিকর অস্ত্র সরাসরি সরবরাহ করছে না। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার দেওয়া গোলার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এর মজুত থেকে ইউক্রেনকে গোলা সরবরাহ করতে পারছে।
১৯৫৩ সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে অস্ত্রবিরতি হয়। কিন্তু কোরিয়ান যুদ্ধ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়নি। দুই কোরিয়ার মধ্যে তখন থেকেই অস্ত্র-প্রতিযোগিতা চলছে। দুই দেশই বিশ্বের অন্যতম বড় দুটি সেনাবাহিনী ও অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলেছে।
বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও উত্তর কোরিয়া এর সামরিক গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি ব্যবহার করে সোভিয়েত মিসাইলব্যবস্থা থেকে নিজেদের মিসাইল তৈরি করেছে এটি। ধারণা করা হয়, ইউক্রেন থেকে কালোবাজারে রকেট কিনে নিজেদের আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরি করেছে এটি। সিরিয়া ও ইরানের মতো দেশে অস্ত্রও বিক্রি করে দেশটি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহায়তা হিসেবে পাওয়া অস্ত্রের নকল করে নিজেদের সামরিক শিল্প গড়ে তুলেছে দক্ষিণ কোরিয়া। রাশিয়ান প্রযুক্তির সমন্বয়ে নিজেদের প্রথম মহাকাশ রকেটও নির্মাণ করেছে দেশটি। বর্তমানে ট্যাংক, হাউটজার, যুদ্ধবিমান, মিসাইল, সাঁজোয়া যান ইত্যাদির মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার।
সিউলের আসান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ-এর সামরিক বিশেষজ্ঞ ইয়াং উক বলেন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনো স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো একে অপরের সঙ্গে সামরিক ও অস্ত্র প্রতিযোগিতায় রয়েছে। এ কারণেই ওয়াশিংটন ও মস্কো এ দুই দেশের কাছে অস্ত্রের সন্ধান করছে।
ইউক্রেনযুদ্ধে দুই পক্ষের মাঝেই আর্টিলারি গোলার চাহিদা তীব্র। দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকায় এখন পর্যন্ত কতগুলো গোলা পাঠিয়েছে তা নিয়ে দুই কর্তৃপক্ষই নিশ্চুপ। আর নিজেদের অস্ত্র বিষয়ক যেকোনো তথ্যকে অতি গোপন হিসেবে বিবেচনা করে দক্ষিণ কোরিয়া।
তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর কাছে প্রায় লাখখানেক আর্টিলারি গোলা বিক্রি করেছে বা ধার দিয়েছে।
মস্কো অবশ্য সিউলকে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে এটি যেন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ না করে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এটিকে চাপ দিয়েছে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য।
'এখন বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যে এটি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পাওয়া গোলাগুলো ইউক্রেনে পাঠাবে কি না,' বলেন ইয়াং।
এখন পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার গোলা ইউক্রেনে ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে রাশিয়াও যে এ যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার কোনো অস্ত্র বা গোলাবারুদ ব্যবহার করছে তার পক্ষেও কোনো প্রমাণ নেই। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে আর্টিলারি গোলা ও রকেট সরবরাহ করেছে।
কিম আর পুতিনের মধ্যে কোনো অস্ত্রচুক্তি হলে তখন দক্ষিণ কোরিয়াও সরাসরি ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে চাইতে পারে। এ কারণেও কোনো চুক্তি হলে ও মস্কো ও পিয়ংইয়ং চাইবে না সেটি প্রকাশ করতে।
ভ্লাদিমির পুতিন যা চাইছেন তা উত্তর কোরিয়ার কাছে দিব্যি আছে। সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর অস্ত্র গবেষক সিমন টি. ওয়েজম্যান বলেন, 'খুব সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার কাছে কয়েক মিলিয়ন আর্টিলারি গোলা মজুত আছে।'
তিনি আরও জানান, ধারণা করা হয় উত্তর কোরিয়ার কাছে ১০০ মিলিমিটার বা তারও বেশি ক্যালিবারের প্রায় ১০ হাজার আর্টিলারি কামান রয়েছে। এ সংখ্যা সবগুলো ন্যাটো দেশের সমন্বিত আর্টিলারি কামানের চেয়ে বেশি। উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র সোভিয়েত নকশার ওপর তৈরি করা এবং এর আর্টিলারি গোলার ক্যালিবারেরও রাশিয়ার ব্যবহৃত গোলার সঙ্গে মিল রয়েছে।
তবে একটি বড় প্রশ্ন হলো, ধরা না পড়ে কত দ্রুত উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার চাহিদামতো পরিমাণে গোলাবারুদ সরবরাহ করতে পারবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অস্ত্র দেওয়ার বদলে উত্তর কোরিয়া রাশিয়া থেকে খাবার, জ্বালানি এবং এর সোভিয়েত যুগের পুরোনো যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, হাউটজার ও সাবমেরিনের জন্য যন্ত্রাংশ চাইতে পারে। এছাড়া রাশিয়ার সুখোই যুদ্ধবিমানের নতুন ভার্সন এবং এস-৩০০ ও এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রতিও চোখ রয়েছে উত্তর কোরিয়ার।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, পুতিনের সঙ্গে কিমের কূটনীতি হয়তো কেবল অস্ত্র বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি কিম জং উনের নীতিতে পরিবর্তনের দিকেও কিছুটা ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তবে দুই দেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও অনেকেই সন্দেহ করছেন পুতিন হয়তো উত্তর কোরিয়াকে ব্যালিস্টিক মিসাইল সমৃদ্ধ করার বা পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির প্রযুক্তি সরবরাহ করার মতো দূর-পদক্ষেপ নেবেন না।