ত্রুটিযুক্ত কোরিয়ান 'মুন জার' কেন লাখ লাখ ডলারে বিক্রি হয়!
পুরনো, গোল, ত্রুটিযুক্ত এবং সুন্দর- এভাবেই কোরিয়ান শিল্পের ভক্তরা 'মুন জার' বা 'ডালহাংগারি'কে বর্ণনা করে। দেখতে সাদাসিধে, কারুকার্যহীন সাদা রঙের এই পাত্রগুলো কে-পপ ব্যান্ড বিটিএসের র্যাপার আরএম থেকে শুরু করে দার্শনিক অ্যালা দে বোতো- সবাইকেই অভিভূত করেছে।
লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের সাবেক পরিচালক বেথ ম্যাককিলপ মুন জারকে 'কোরিয়ান পরিচয়ের প্রতিমূর্তি' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আর দামের নিরিখে যদি জনপ্রিয়তা বিচার করা হয়, তাহলেও এই পাত্রগুলোর দাম শুনে আপনার চোখ কপালে উঠবে! সম্প্রতি ক্রিস্টি'স-এর নিলামে ৪.৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে একটি মুন জার।
১৭ শতকের শেষভাগে কিংবা ১৮ শতকের শুরুর দিকে তৈরি একটি বিরল মুন জার চলতি মাসে নিউইয়র্কে সোথবি'স এর নিলামে তোলা হবে। নিলামে এটি ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি দামে বিক্রি হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
"বড় আকৃতির মুন জার সবসময়ই বেশ দামি হয়। কিন্তু আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে এটির যে আবেদন তৈরি হয়েছে সে কারণেই এগুলোর দাম ও মূল্যমান আকাশছোঁয়া। দলে দলে আন্তর্জাতিক নিলামকারীরা এই শিল্পকর্মের কেনাবেচা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন, তাই এটা এখন শুধু কোরিয়ান শিল্প-সমঝদারদের শিল্প নিদর্শন সংগ্রহের নেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই", বলেন আমেরিকা ও ইউরোপ অঞ্চলে সোথবি'স-এর 'চাইনিজ ওয়ার্কস অব আর্ট' বিভাগের প্রধান অ্যাঞ্জেলা ম্যাকঅ্যাটিয়ার।
তাছাড়া, মুন জারের অবিশ্বাস্য রকম উচ্চমূল্যের কারণেও এগুলো বিরল হিসেবে বিবেচিত। যদিও কোরিয়া শাসনকারী শেষ রাজবংশ, জোসন রাজবংশের সময় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে রাজকীয় চুল্লীতে এই পাত্রগুলো তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে অতি অল্প সংখ্যক মুন জার টিকে আছে। বড় সাইজের পাত্র (১৫.৭ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ) টিকে রয়েছে মাত্র ১২ থেকে ৩০টি।
বিভিন্ন নিলাম হাউজ এবং অ্যান্টিক ডিলারদের হাত পেরিয়ে কিছু কিছু মুন জার এখন ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং বোস্টনের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস-এ জায়গা করে নিয়েছে; সেইসঙ্গে কিছু পাত্র গিয়েছে ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছে।
'এক টুকরো সুখ'
কোরিয়ান শিল্পের এই বিখ্যাত নিদর্শনটিকে সাধারণ কোনো পাত্র ভাবলে ভুল করা হবে। শুধুমাত্র দাম এবং বিরল শিল্পকর্মের দিক থেকেই নয়, এই পাত্রের সঙ্গে মানুষের গভীর আবেগ ও অনুভূতিও জড়িয়ে আছে।
ইতিহাস বলে, ১৬৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে গোয়াংজু শহরে রাজকীয় চুল্লীতে প্রথম মুন জার তৈরি করা হয়। সাদা চীনামাটি এবং কাওলিন কাদামাটির সাহায্যে এই পাত্রগুলো তৈরি করা হতো এবং তখনকার দিনের নব্য-কনফুসিয়ান ফ্যাশন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে উপযুক্ততা, নম্রতা, মিতব্যয়িতা এবং বিশুদ্ধতার মতো মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে এর মধ্যে। এই পাত্রগুলো রাজদরবারে এবং উচ্চবিত্তদের ঘরে খাবার বা তরল কিছু রাখার কন্টেইনার হিসেবে কিংবা ঘর সাজানোর পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয়।
২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুন জার আন্তর্জাতিক মহল থেকেও প্রশংসা পেতে শুরু করে; এর জন্য জাপানি ফোক ক্রাফট বিষয়ক পণ্ডিত ইয়ানাগি সোয়েৎসু এবং ব্রিটিশ মৃৎশিল্পী বার্নার্ড লিচকে ধন্যবাদ দিতেই হয়- যিনি সিউলের একটি অ্যান্টিকের দোকান থেকে ১৯৩৫ সালে একটি মুন জার কিনে এনেছিলেন। লিচ একবার বলেছিলেন, একটা মুন জার নিজের কাছে থাকা মানে 'এক টুকরো সুখের মালিকানা পাওয়া'। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পাত্রটিকে আরেক মৃৎশিল্পী লুসি রাইয়ের কাছে দিয়ে যান নিরাপদে রাখার জন্য। লুসির মৃত্যুর আগপর্যন্ত এটা তার স্টুডিওতেই ছিল এবং পরে তা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের হাতে চলে যায়।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর কোরিয়ান আর্ট হিস্টোরি বিভাগের প্রভাশক শার্লট হরলিক আর্ট বুলেটিন নামক জার্নালে লিখেছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুন জার উত্তর-ঔপনিবেশিক কোরিয়ান শিল্পী গোষ্ঠী ও পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে- যারা কিনা কোরিয়ান শিল্পের ইতিহাস ও জাতীয় পরিচয় পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। তারা মুন জারের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন কারণ স্বতন্ত্র কোরিয়ান শিল্পকর্মের উদাহরণ হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আধুনিকতাবাদের সঙ্গেও এটির সাদৃশ্য ছিল।
মুন জারের আকর্ষণ
সোথবি'স যখন তাদের আসন্ন নিলামের কথা ঘোষণা করে, তখন ৪৪ সেন্টিমিটার বা ১৭.৩ ইঞ্চি উচ্চতার মুন জারটিকে তারা এমন একটি বস্তু হিসেবে আখ্যা দেয় যা এটির সামনে উপস্থিত সবাইকে অনুপ্রাণিত, বিস্মিত করে এবং এক ধরনের প্রশান্তি দেয়। একটা সাদামাটা পাত্রকে নিয়ে এমন স্তুতি হয়তো অনেকের হাসির খোরাক হতে পারে, কারণ এমনভাবে বলা হয়েছিল যেন এটি জীবন্ত কোনো প্রাণী। কিন্তু মানুষের ওপর এটির আবেগীয় প্রভাবের কথা বারবার সাহিত্যে উঠে এসেছে।
কোরিয়ার জাতীয় জাদুঘরের সাবেক পরিচালক চে সুনু এই জাদুঘরের মুন জারগুলোকে মানুষের 'সঙ্গী' অথবা অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে অভিহিত করেছেন, যেগুলো তাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তার ভেতরের সৃজনশীলতাকে নাড়া দিয়ে গেছে। বার্নার্ড লিচ পাত্রগুলোকে এগুলোর 'সহজাত আত্মচেতনাহীনতা'র জন্য প্রশংসা করেছেন। ২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন একীকরণ মন্ত্রী ইউ উ-ইক এই পাত্রটিকে পুনরায় একত্রিত কোরিয়ান উপদ্বীপের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন (দুটি আলাদা গোলার্ধের আকৃতিতে বানিয়ে মাঝখানে জোড়া দিয়ে তৈরি হয় মুন জার।)
হালের জনপ্রিয় বিটিএস তারকা আরএম আধুনিককালের একটি মুন জারকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে টুইটারে ছবি পোস্ট করেন এবং ভক্তদের বলেন যে, এটি তার মন শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
ম্যাকএটিয়ার বলেন, "একটা পাত্র কিভাবে মানুষকে শান্ত থাকতে সাহায্য করে সেটা বিশ্বাস করা অনেকের পক্ষেই কঠিন। এর মধ্যে ধ্যান বা চিন্তাশীলতার একটা উপস্থিতি আছে। আপনি যদি মার্ক রথকোর (বিখ্যাত মার্কিন শিল্পী) একটা বিখ্যাত চিত্রকর্মের সামনে বসে থাকেন, তাহলে আপনার মনে হবে সেখান থেকে একটা প্রাণশক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে এবং আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটার সামনে বসে থাকতে পারবেন- মুন জারও সেরকমই একটা বস্তু।"
"আপনি যতই এটার দিকে তাকিয়ে থাকবেন, ততই আরও বেশি দেখতে মন চাইবে। প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ভিন্ন রকম মনে হয়। আমাদের এটার ছবি তুলতেই হিমশিম খেতে হয়েছে, কারণ যতবার আপনি পাত্রটাকে ঘুরাবেন বা আলোকসজ্জা পরিবর্তন করবেন, ততবারই মনে হবে যেন আলাদা জিনিস দেখছেন। পাত্রটির উপরিতলকে সত্যিই জীবন্ত মনে হয়। আপনার মনে হবে আপনি যেন এর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছেন!" যোগ করেন তিনি।
আধুনিক শিল্পীদের কাজ
আধুনিক কোরিয়ান মৃৎশিল্পীরা মুন জার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের মতো করে একই ধরনের পাত্র তৈরি করেছেন। সিরামিস্ট কিম সিয়ং তার নির্মিত পাত্রের উপরিতলে কালো চকচকে রঙ দিয়েছেন; অন্যদিকে, ইয়ুন জু চিওল অনেকটা পাফারফিশের মতো দেখতে ছুঁচালো রূপ দিয়েছেন তার পাত্রের; এবং চে বো রুম তৈরি করেছেন বার্নিশবিহীন, অমসৃণ, ডেনিম নীল শেডের মুন জার।
তবে ৭১ বছর বয়সী সিরামিস্ট কন দে সুপ অতীতের মৃতশিল্পীদের প্রক্রিয়া অনুসরণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি তার তৈরি পাত্রগুলোকে একেবারেই অলঙ্কৃত করেন না, বরং ত্রুটিগুলোকেই এই পাত্রের বিশেষত্ব হিসেবে ফুটিয়ে তোলেন। তিনিও গোয়াংজুর একটি স্টুডিওতে কাজ করেন, যেখানে অতীতে রাজকীয় চুল্লীগুলোতে মুন জার তৈরি করা হতো।
বলে রাখা ভালো, ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়ায় মুন জার তৈরি বেশ কষ্টসাধ্য। প্রক্রিয়াটি শ্রম-নিবিড় ধৌত করা, কাদামাটি থেকে ময়লা দূর করা, বাতাস যেন না থাকে তার জন্য পেষণ ও রোল করা, এই বিশাল মাটির দলা বয়ে নিয়ে যাওয়া; সেইসঙ্গে হাত দিয়ে সঠিক আকৃতি দেওয়া। এরপরে চুল্লীর মধ্যে ২৪ ঘণ্টা ধরে পাইন কাঠের আগুন জ্বালিয়ে রেখে পাত্রগুলো পুড়িয়ে শক্ত করা। এমনকি পুরনো কৌশল অবলম্বন করতে কন দে সুপ নিজস্ব চুল্লীও তৈরি করেছেন।
সিএনএনকে এই সিরামিস্ট বলেন, "আমি এগুলো বানাই কারণ কাজটা আমার কাছে মজা লাগে। প্রতিবার যখন আমি কিছু বানাই, এটা অভিনব মনে হয়... প্রতিবারই উপাদানগুলোর মান ভিন্ন রকম হয়। প্রতিবারই পাত্র বানানোর সময় নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করি।"
কন দে সুপ আরও জানান, মুন জারের সঙ্গে তার একটা আবেগ জড়িয়ে আছে। ছাত্রাবস্থায় একবার একটা কোরিয়ান অ্যান্টিকের দোকানে এই পাত্র দেখে তিনি এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ভবিষ্যতে এটাই হবে তার পেশা। "এগুলোকে জীবন্ত মনে হয়", বলেন এই শিল্পী।
২০১৯ সালে তাঁর কাজের উপর ভিত্তি করে অক্সল ফেরভুলট গ্যালারির প্রকাশিত বইয়ে তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, তিনি এমন শিল্পকর্ম তৈরির চেষ্টা করেন যেগুলোর মধ্যে কিছু সংযুক্ত করার বা বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। "আমি এমন শিল্পকর্ম তৈরি করতে চাই যার একটা চিত্তাকর্ষক ও প্রভাবশালী উপস্থিতি থাকবে; তবে এগুলো যেখানেই প্রদর্শিত হোক না কেন, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য বা ছন্দ বজায় রাখবে। যারাই এটা দেখবে, তারা যেন মনে শান্তি এবং স্বস্তি অনুভব করে।"