কানাডা-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনে শঙ্কায় পাঞ্জাবের শিখরা
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে হত্যার জেরে ভারত ও কানাডার মধ্যে সৃষ্ট তিক্ত বিরোধ ভারতের পাঞ্জাবেও অনুভূত হচ্ছে। ভারতের এই রাজ্যটিতে বসবাসকারী শিখদের অনেকেই ভারতের হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সরকারের রোষানলে পড়ার পাশাপাশি উত্তর আমেরিকায় তাদের উন্নত জীবনের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টিরও আশঙ্কা করছেন।
২৫ বছর আগে উত্তর ভারতের এই রাজ্য ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমান হরদীপ সিং নিজ্জার এবং কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করেন। সেখানে তিনি একজন প্লাম্বার হিসেবে কাজ করতেন এবং এর পাশাপাশি একটি গুরুদুয়ারার সভাপতি ছিলেন। ভ্যাঙ্কুয়েভারের শহরতলী এলাকা সারি'তে গত ১৮ জুন হরদীপ সিংকে গুরুদুয়ারার বাইরে তার নিজের গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো হাউজ অব কমনস বা দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষে বলেছেন যে, হরদীপ সিং হত্যার পেছনে ভারত সরকারের এজেন্টদের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়ে 'বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের' তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা।
২০২০ সালে নিজ্জারকে 'সন্ত্রাসী' তকমা দেওয়া ভারত জাস্টিন ট্রুডোর এমন বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয় এবং এ অভিযোগকে 'অযৌক্তিক' বলে আখ্যা দেয়। শুধু তাই নয়, এ ঘটনার জেরে ভারতে নিযুক্ত কানাডার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে নয়াদিল্লি এবং ভারতীয় নাগরিকদের কানাডায় ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে। একইসঙ্গে, কানাডীয় নাগরিকদের ভিসা আবেদন স্থগিত করেছে ভারত এবং দেশটিতে কানাডার কূটনৈতিক তৎপরতা হ্রাস করা হয়েছে।
ভারতের ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ শিখ হলেও, পাঞ্জাবে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৩০ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই রাজ্যেই ৫০০ বছর আগে শিখ ধর্ম জন্মলাভ করেছিল। অন্যদিকে, পাঞ্জাবের বাইরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিখ বাস করেন কানাডায় এবং দেশটিতে বিভিন্ন সময়ে শিখদের নানা আন্দোলন-প্রতিবাদ ভারতের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কানাডায় যাওয়ার স্বপ্ন
ভারতে শিখদের আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে 'খালিস্তান আন্দোলন' ১৯৮০'র দশকে চরম আকার ধারণ করে এবং পাঞ্জাবে সহিংস বিদ্রোহ শুরু করেন এ আন্দোলনের কর্মীরা। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ আন্দোলন দমনে ব্যবস্থা নেন। ফলে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ভারতের সরকারি বাহিনীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনা ঘটে ১৯৮৪ সালে।
কিন্তু বলপ্রয়োগ করে দমন করা হলেও এ আন্দোলনের শিখা নিভে যায়নি।
পাঞ্জাবের ভরসিংপুরা গ্রামে এখনও হরদীপ সিং নিজ্জারের কিছু স্মৃতি টিকে আছে। কিন্তু নিজ্জারের মামা, ৭৯ বছর বয়সী হিম্মত সিং নিজ্জার বলেন, নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে যে অভিযোগ তুলেছেন ট্রুডো, স্থানীয়রা এটিকে 'খুব সাহসী বলে মনে করেছেন'।
চারদিকে ধানক্ষেত ও কলা গাছে ঘেরা খামাবাড়িতে একটা ট্রাক্টরের পাশে বেঞ্চে বসে প্রবীণ এই ব্যক্তি রয়টার্সকে বলেন, "একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য তার নিজের সরকারের উপর এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার দরকার ছিল না।"
কিন্তু হিম্মত সিং জানান, তিনি কানাডার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি এবং পাঞ্জাবের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত।
"এখন সব পরিবারই চায় তাদের ছেলেমেয়েদের কানাডা পাঠাতে, যেহেতু এখানে কৃষিকাজ আর তেমন লাভজনক নয়", বলেন হিম্মত সিং।
কানাডায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা। গত বছর উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে পড়তে যাওয়া ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৪৭ শতাংশ বেড়ে ৩ লাখ ২০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
'ভীতিকর পরিবেশ'
"এখন আমরা ভয় পাচ্ছি যে কানাডা শিক্ষার্থীদের ভিসা দেবে কিনা কিংবা ভারত সরকার এক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে কিনা", বলেন কানাডায় যেতে ইচ্ছুক আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী গুরসিমরান সিং।
শিখদের সবচেয়ে পবিত্র মন্দির, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন গুরসিমরান সিং। এই মন্দিরে অনেক শিক্ষার্থী তাদের ভিসার জন্য প্রার্থনা করতে অথবা ধন্যবাদ (ভিসা পেয়ে) বা কৃতজ্ঞতা জানাতে যান।
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের জন্য ১৯৮৪ সালে অমৃতসরের এই স্বর্ণমন্দিরেই অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তার নির্দেশে ঐ বছরের পহেলা জুন স্বর্ণমন্দির চত্বরে সেনা প্রবেশ করে, শুরু হয় অপারেশন ব্লু স্টার। পরে একই বছরের ৩১শে অক্টোবর নিজের শিখ দেহরক্ষীদের হাতে খুন হন ইন্দিরা গান্ধী।
২০২০ সালে শিখ কৃষকরা মোদি সরকারের বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বছরব্যাপী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার পর থেকে পাঞ্জাবের শিখ গোষ্ঠী এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের মধ্যে সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হয়েছে।বিতর্কিত তিনটি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া ছিল নরেন্দ্র মোদির এক বিরল রাজনৈতিক পরাজয়।
নিজ্জারের গ্রামের বাসিন্দা, ৩১ বছর বয়সী সন্দ্বীপ সিং বলেন, মোদি সরকার এখানে একটা 'ভীতিকর পরিবেশ' সৃষ্টি করে রেখেছে, বিশেষ করে তরুণদের জন্য।
"আমরা যদি কোনো প্রতিবাদ করি, তাহলে অভিভাবকরা চাইবেন না তাদের সন্তানরা তাতে অংশ নিক। কারণ তারা এই ভেবে ভীত যে হরদীপ সিং নিজ্জারের কানাডায় যে পরিণতি হয়েছে, তাদের সন্তানদেরও তা-ই হতে পারে", বলেন সন্দ্বীপ।
পাঞ্জাবের কট্টরপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দাল খালসা গ্রুপের রাজনীতি বিষয়ক সম্পাদক কানওয়ার পাল বলেন, "খালিস্তান আন্দোলনের পক্ষে যে-ই লড়াই করবে, সে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য লড়বে। আর ভারত সরকার তাদেরকেই কিনা শত্রু মনে করছে এবং তাদেরকে টার্গেট করেছে।"
তবে এ অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এক মুখপাত্র।
বিজেপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য পাঞ্জাবে কোনো সমর্থন নেই এবং এ ধরনের দাবি ভারতের জন্য হুমকিস্বরূপ। একইসঙ্গে, দলটি বলেছে-শিখদের জন্য নরেন্দ্র মোদি যতখানি করেছেন, অন্য কেউ তা করেনি।