ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমাদের সহায়তা আগামী বছরেই উধাও হবে
যুদ্ধের সমাপ্তি কেবলই পেছাচ্ছে। গতবছর কিয়েভ দখলে অগ্রসর হওয়া রুশ বাহিনীকে সফলভাবে প্রতিরোধের পর ইউক্রেনের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, যুদ্ধের ইতি টানতে আর মাত্র মাসকয়েক লাগবে। ২০২২ সালের মে মাসে দেশটির সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল কিরিলো বুদানভ পূর্বাভাস দেন যে, 'এই বছরের শেষ নাগাদ বেশিরভাগ সক্রিয় লড়াই সম্পন্ন হবে।'
খারকিভে ইউক্রেনের এক সফল আক্রমণ অভিযানের কিছুদিন পর, ওই বছরের নভেম্বরে ইউক্রেনের তৎকালীন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভলোদিমির হাভরিলভ-ও দ্রুত বিজয় অর্জনের আশাপ্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'আমার ধারণা বসন্তের শেষ নাগাদ এই যুদ্ধ সমাপ্ত হবে।'
অথচ এ বছরের জুনের আগপর্যন্ত ইউক্রেনের বহুল আলোচিত দ্বিতীয় কাউন্টার-অফেন্সিভ শুরু হয়নি। এবারেও আশা ছিল, এর সাফল্যের মাধ্যমে যুদ্ধ-সমাপ্তির দিকে এগোবে। কিন্তু, সে প্রত্যাশা পূরণ দূরের কথা, লড়াই যে আরও দীর্ঘদিন চলবে তাই প্রমাণ করেছে কাউন্টার-অফেন্সিভ। ভূমি মাইন ও অন্যান্য রুশ প্রতিরোধের মুখে পায়ে হেঁটে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে হচ্ছে ইউক্রেন সেনাদের। রিজার্ভ সেনা মোতায়েন ও পশ্চিমা সমরাস্ত্র ব্যবহার করেও – রাশিয়ার প্রতিরোধ ভেঙ্গে ফেলার মতো বড় 'ব্রেক থ্রু' অর্জিত হয়নি। তারমধ্যে আসছে বৃষ্টির মওসুম। এই আবহাওয়া ও গোলাবারুদের ঘাটতির ফলে অক্টোবরের আগেই থমকে যেতে পারে ইউক্রেনীয়দের অগ্রযাত্রা। এমনকী তার আগেও হতে পারে।
ফলে যুদ্ধ গড়াবে লড়াইয়ের আরেক মৌসুমে।
এই পরিস্থিতিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, 'ইউক্রেনে একটি দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।' একইদিন তার সাথে একমত পোষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জেনারেল মার্ক মিলি বলেন, 'ইউক্রেনের রুশ-অধিকৃত অঞ্চল থেকে দুই লাখ রুশ সেনার সবাইকে সামরিকভাবে বিতারিত করতে যথেষ্ট দীর্ঘ সময় দরকার।'
যুক্তরাষ্ট্র বারবার জোর দিয়ে বলেছে, 'যত সময়ই লাগুক' দেশটি ইউক্রেনের পাশে থাকবে। চলতি বছর বেশ কয়েকবার এ অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির মতোন ইউক্রেনের ইউরোপীয় সমর্থকরাও একই কথা বলে আসছে। এ প্রতিশ্রুতি শুনতে যতই লৌহদৃঢ় মনে হোক, তা রক্ষা করা নির্ভর করছে- অনিশ্চিত দুটি বিষয়ের ওপর। প্রথমটি হলো– পশ্চিমাদের ইউক্রেন সেনাবাহিনীকে প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার সামর্থ্য। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এসব সহায়তা হস্তান্তরের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
প্রথমটি ব্যাখ্যা করার আগে, প্রতিপক্ষের অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। রাশিয়ার অর্থনীতি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ রিচার্ড কনলি জানান, ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিক থেকেই যুদ্ধকালীন উৎপাদনে রয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প। এসময়ে দেশটির ইস্পাত উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার তথ্য উল্লেখ করেন তিনি। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে রাশিয়া বছরে ২০০টি ট্যাংক নির্মাণ করতে পারবে। আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, এই সংখ্যা তারও দ্বিগুণ।
এই প্রেক্ষাপটে কনলি বলেছেন যে, সংস্কার করা পুরোনো ট্যাংকসহ এই সংখ্যা ৫০০-৮০০টি হতে পারে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার সমরাস্ত্র উৎপাদন সেভাবে হ্রাস করতে পারেনি বলেও জানান তিনি। কারণ, সেমিকন্ডাক্টর বা কম্পিউটার চিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হংকং ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো থেকে রাশিয়ায় পাচার করা হচ্ছে।
তাত্ত্বিকভাবে, রাশিয়াকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় হারাতে ইউক্রেনকে সাহায্য করার সামর্থ্য আছে পশ্চিমা মিত্রদের। ন্যাটো-সদস্য দেশগুলোর মোট জিডিপি রাশিয়ার চেয়ে ১২গুণ বেশি। এখানে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে মস্কোর দৃঢ়সংকল্প। যুদ্ধের পেছনে বিপুল বিনিয়োগে কোনো দ্বিধা নেই ক্রেমলিনের। বর্তমানে দেশটির জাতীয় বাজেটের ৪০ শতাংশই সামরিক খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় যা অনেকটাই বেশি। এই পার্থক্য দূর করার চেষ্টা হিসেবে ন্যাটো দেশগুলোও অস্ত্র উৎপাদনে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু, স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর থেকেই ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা বড় পরিসরে অস্ত্র উৎপাদনে মনোযোগ দেয়নি। ফলে এই চেষ্টা তাদের জন্য আরও সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
উৎপাদন খরচও বেশি ন্যাটো সদস্যদের। যেমন প্রতিটি কামানের গোলা উৎপাদনে এস্তোনিয়ার গড় ব্যয় ৫ থেকে ৬ হাজার ডলার। এ তথ্য উল্লেখ করে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কস্তি সাম বলেন, সে তুলনায় প্রতিটি গোলা উৎপাদনে রাশিয়ার গড় ব্যয় ৬২০ ডলার বা ৬০ হাজার রুবল। রাশিয়ায় কাঁচামাল ও মজুরি কম হওয়াই এ বড় পার্থক্যের কারণ। তাছাড়া, বেশিরভাগ সমরাস্ত্র কারখানাই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন।
মূল্যস্ফীতির কারণেও পশ্চিমাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। ন্যাটোর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল রব বাওয়ের গত ১৬ সেপ্টেম্বর বলেছেন, 'সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদের দাম ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।'
দ্বিতীয় বাধা সময় নিয়ে। কনলি জানান, শুরুতে রাশিয়ার অস্ত্র উৎপাদনের গতি মন্থর থাকলেও, এখন তারা পূর্ণদ্যমে ছুটছে। ফলে যে হারে তাদের উৎপাদন দরকার, সেভাবেই করতে পারছে।' অন্যদিকে, ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিরক্ষা শিল্পে উৎপাদন বাড়াতে বিনিয়োগটা বেশ দেরীতেই শুরু হয় যুদ্ধ শুরুর পর, ফলে নতুন বিনিয়োগ থেকে ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ বা ২০২৫ সালের আগে তেমন সুবিধা পাওয়া যাবে না। এই ফাঁকে নতুন করে সেনা সমাবেশ, প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরির সুযোগ পেয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনীয় বাহিনীর গতিরোধ করেছে।
আর্টিলারি গোলার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের জন্য সুসংবাদ হলো– ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন বাড়ছে। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের বার্ষিক উৎপাদন হার আগের এক লাখ ৬৮ হাজার থেকে বর্তমানে তিন লাখ ৩৬ হাজার রাউন্ডে উন্নীত হয়েছে। নতুন কারখানা স্থাপন ও পুরোনোগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর ফলে এটা ক্রমে আরও বাড়তেই থাকবে।
এস্তোনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, এই বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের শুরুতে দ্বিগুণ হবে ইউরোপের উৎপাদন হার। ফলে আগামী বছর নাগাদ আমেরিকা ও ইউরোপ মিলে বার্ষিক ২০ লাখ রাউন্ড গোলা উৎপাদন করবে।
শেল শক
কিন্তু,সমস্যা হলো- উৎপাদনের এই হার কোনোরকমে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতোন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ধারণা, আগামী বছর রাশিয়া ১০ থেকে ২০ লাখ রাউন্ড গোলা উৎপাদন করবে। ইতোমধ্যেই তাদের কাছে ৫০ লাখ রাউন্ড গোলা মজুদ আছে, নতুন উৎপাদন তার বাড়তি সংযোজন হবে। ফলে চাইলেই রুশ বাহিনী দৈনিক অন্তত ১৫ হাজার রাউন্ড গোলা ছুঁড়তে পারবে বলে জানান কস্তি সাম।
কাউন্টার-অফেন্সিভ চালানোর সময় ইউক্রেনও এই হারে গোলা ব্যবহার করেছে। কিন্তু এটা হার তারা বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না। বড় জোর আর দু-তিন মাস। সে তুলনায়, রাশিয়া চাইলে পুরো এক বছর জুড়ে তা করতে পারবে। ইউক্রেন যুদ্ধে গোলন্দাজ বাহিনী যে বিশাল ভূমিকা রাখছে, তাতে কিয়েভের বাহিনীর জন্য সামনে শনির দশা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই ঘাটতি মেটাতে বিশ্বের অন্যত্র হাত পাততে হচ্ছে পশ্চিমা মিত্রদের। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার দেওয়া বিপুল পরিমাণ গোলার সুবাদে ইউক্রেনের দ্বিতীয় কাউন্টার-অফেন্সিভ চালানো সম্ভব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলো গোপনে মিশর ও পাকিস্তানের মতো দেশ থেকেও প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনেছে ইউক্রেনের জন্য। কিন্তু, ক্রয়যোগ্য সরবরাহ দিন দিন কমে আসছে। পশ্চিমা মজুদেও টান পড়েছে।
এই অবস্থায়, পশ্চিমা প্রতিরক্ষা শিল্প উৎপাদন বাড়ানোয়, ন্যাটোর নিজস্ব মজুদের ঘাটতি হয়তো কিছুটা দূর হবে। পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মতে, ২০২৫ সাল নাগাদ তাদের কাছে গোলার উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। কিন্তু, নতুন উৎপাদন থেকে যদি ইউক্রেনকে দেওয়া হয়, এবং যদি চীন বা উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে গোলা সরবরাহ না করে, তাহলে হয়তো এই সংঘাতে প্রথমবারের মতো রুশ বাহিনীকে পর্যদুস্ত করার মতো গোলার ভাণ্ডার থাকবে ইউক্রেনীয়দের। কিন্তু, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২৫ সাল অনেক দূরঅস্ত বিষয়; এরমধ্যে আগামী বছরে বড় আক্রমণ চালানোর ক্ষেত্রে হিমশিম খাবে ইউক্রেন।
রাজনীতির বিচারে আগামী বছরও যেন এক জীবনকাল দূরের বিষয়। ইউরোপের রাজনৈতিক হাওয়া আপাতত ইউক্রেনের অনুকূলে বলেই মনে হচ্ছে। গত জুন ও জুলাইয়ে করা জরিপে ৬৪ শতাংশ ইউরোপীয় ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। রাশিয়ার ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই সন্দিহান সুইডেনের ৯৩ শতাংশ জনগণ এ মতপ্রকাশ করেন। অন্যদিকে, রুশ সীমান্ত থেকে বহুদূরে থাকা পর্তুগালে সমর্থনের হার ছিল ৯০ শতাংশ।
তবে কট্টর ডানপন্থী কিছু দল– যেমন মারি লা পেনের নেতৃত্বাধীন ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালি এবং জার্মানির অলটার্নেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) এই সহায়তাকে ইউরোপের সম্পদের অপচয় হিসেবে অভিহিত করছে।
বার্লিনের আঞ্চলিক আইনসভার এএফডির সদস্য গুনার লিন্ডেম্যান বলেন, 'এই যুদ্ধের জন্য জার্মানির জনগণ তিনগুণ বেশি মূল্য দিচ্ছে। আমরা ১০ লাখ শরণার্থীকে সহায়তা দিচ্ছি, জ্বালানির বিপুল ব্যয় বহন করছি, আবার ইউক্রেনে অস্ত্রও পাঠাচ্ছি।'
সমস্যা হলো– সাম্প্রতিক জরিপগুলোয় উভয় দলেরই জনসমর্থন বাড়তে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু, এখনও ক্ষমতায় আসার মতো সমর্থন থেকে দূরে আছে তারা।
যুদ্ধ-বিরোধী এই মনোভাবের বিষয়ে সতর্ক আছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। বিশেষত, তার নিজ দল সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরের এই মনোভাব নিয়ে তার উদ্বেগ আছে। একারণেই, ইউক্রেনকে লেপার্ড ট্যাংক দেওয়ার আগে মাসকয়েক দেরি করেন তিনি। ইউক্রেনকে দুরপাল্লার তাউরাস মিসাইল দিতে এখনও রাজি হচ্ছেন না তিনি। যদিও একই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়েছে ফ্রান্স ও ব্রিটেন।
শলৎজ এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক পরিণতি নিয়ে চিন্তিত। কারণ তিনি জানান, নতুন অস্ত্র পাঠানোর কিছুদিনের মধ্যেই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জনসমর্থন জরিপে।
তারপরও অবশ্য গত ১৮ সেপ্টেম্বর তার সরকার ইউক্রেনকে ৪০০ মিলিয়ন ইউরোর অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান ও মাইন-অপসারণকারী সরঞ্জাম দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
পুতিনের সাথে ঘন ঘন ফোনালাপে অংশ নেওয়া এবং অস্ত্র পাঠাতে দ্বিধা করায় গত বছর কিয়েভের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। বর্তমানে তিনিই ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে ইউক্রেনের পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার। ইতঃপূর্বে ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়ার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু, বর্তমানে মাখোঁ এই ব্লকে কিয়েভের অন্তর্ভুক্তির জোরালো এক সমর্থক। জুলাইয়ের এক জরিপে দেখা যায়, ৫৮ শতাংশ ফরাসী নাগরিক একে সমর্থন করছে।
কয়েক বছর আগে যে অচলাবস্থা ছিল, বর্তমানে ইইউ'তে ইউক্রেনের সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টা তার চেয়ে অনেক বিস্ময়কর গতি পেয়েছে। ২০২২ সালের জুনে ইইউ এর প্রার্থী রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় ইউক্রেন। এবছরের ডিসেম্বরে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বাধা না আসলে সদস্যপদ নিয়ে আলোচনাও শুরু হবে। দ্রুতগতিতে বিভিন্ন সংস্কার করে ইইউ কর্মকর্তাদের অভিভূত করছে কিয়েভ। তারপরেও পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পেতে বেশ কয়েক বছর লাগতে পারে। যুদ্ধের কারণে এই প্রক্রিয়ায় ইইউ এর দেরির করাটাই স্বাভাবিক হলেও, উল্টো তা দ্রুততর হয়েছে।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত ও বিভাজিত এক অবস্থা দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। গত ১০ আগস্ট প্রতিনিধি পরিষদের কাছে ইউক্রেনের জন্য আরও ২৪ বিলিয়ন ডলার সম্পূরক বাজেট সহায়তার অনুমোদন চায় হোয়াইট হাউস। যা অনুমোদিত হলে ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা পৌঁছাবে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে। প্রতিনিধি পরিষদের উভয় কক্ষে এই সহায়তার সমর্থক ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা সুস্পষ্টভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে প্রস্তাবটি কন্ঠভোটে তোলা হলে সহজেই অনুমোদন লাভ করবে।
কিন্তু, তা হওয়ার সম্ভাবনা কম, আমেরিকার বর্তমান বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক আবহের কারণে। প্রতিনিধি পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য হয়তো ইউক্রেনের পক্ষে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যক রিপাবলিকান সদস্য চরম ইউক্রেন-বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করেন।
এই আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ম্যাট গেটজ এমনকি ন্যাটোতে রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আবার ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত মার্জরি টেইলর গ্রিন দাবি করেছেন, ইউক্রেনকে ডেমোক্রেট দলের দাতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।
মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এগিয়ে, একারণে এবং স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি আইন পাসের জন্য ডেমোক্রেট সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল হতে না চাওয়ায়– রুশপন্থী রিপাবলিকানদের এই অংশটি বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।
ফলে স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি খুব সম্ভবত ইউক্রেনের জন্য সম্পূরক বাজেট সহায়তাকে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের সাথে জুড়ে দেবেন। ফলে এটি পাস না হওয়ার ঝুঁকি কমবে। এর আগেও ইউক্রেনকে তহবিল দিতে বাধার মুখে পড়েছে হোয়াইট হাউস, তবে প্রতিবারই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। তবে প্রতিটি প্রস্তাবের বিপক্ষেই রিপাবলিকানদের ভোট বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
বিদ্যমান মজুদ থেকে ইউক্রেনকে আরও ৬ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠাতে এরমধ্যেই কংগ্রেসের অনুমোদন পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু, এরপর ২৪ বিলিয়ন ডলারের সম্পূরক সহায়তা দিতে কংগ্রেস আরও কয়েক মাস দেরি করতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর যেভাবে একের পর এক বৃহৎ প্যাকেজ সহায়তা দিয়েছে, আগামীতে তার ছিটেফোঁটাই হয়তো পাবে ইউক্রেন।
দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া নিয়ে সমর্থন ও বিরোধিতা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দলীয় বিষয়ে রূপ নিচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে এটি অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বারা প্রভাবিত রিপাবলিকান অনেক ভোটারই এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। সে তুলনায়, সার্বিকভাবে সহায়তার পক্ষে আছে ডেমোক্রেট ভোটাররা।
কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল বাজেট ঘাটতি থাকায়– ক্রমবর্ধমান সরকারি দেনা ও উচ্চ সুদের ব্যয় – আরও বাড়াতে সব দলের রাজনীতিবিদদেরই অনীহা আছে। এমনকী অনেক ডেমোক্রেটও মনে করছেন, এই সংঘাতের সিংহভাগ ব্যয় বহন করা উচিত ইউরোপীয় মিত্রদের। কারণ, তাদের অঞ্চলেই ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে।
আর যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন, এবং জিতেও যান আগামী বছরের নির্বাচনে– তাহলে ইউক্রেনের বিষয়ে তার নীতি ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। গত মার্চে তিনি অঙ্গীকার করেন, নির্বাচিত হলে হোয়াইট হাউসে প্রবেশের আগেই একদিনের মধ্যে যুদ্ধের অবসান করবেন।
গত মে মাসে তিনি বলেন, 'আমাদের নিজেদেরই যথেষ্ট গোলাবারুদ নেই। কিন্তু, আমরা অনেক বেশি দিয়ে ফেলছি।'
তবে তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলে তিনি ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে এমন অন্যায় চুক্তির জন্য চাপ দেবেন না, যার মাধ্যমে দখলীকৃত এলাকার কর্তৃত্ব পাবে মস্কো।
ট্রাম্প বলেন, 'আমি সবার জন্য ন্যায্য একটি চুক্তি করব।'