এশিয়ার অর্থনৈতিক বিপ্লব বিশ্বের জন্য কতটা অর্থপূর্ণ হবে!
ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক অর্জনগুলোকে তুলে ধরে 'ফ্যাক্টরি এশিয়া' এ উক্তিটি। গত পাঁচ দশকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান থেকে শুরু করে চীন হয়ে উঠেছে পণ্য উৎপাদনের ব্যস্ত কেন্দ্র। যা তারা রপ্তানি করছে বাকি বিশ্বে, বিশেষত সম্পদশালী পশ্চিমা দেশগুলোতে। পণ্য উৎপাদন করে কোটি কোটি এশীয় দারিদ্র্য মুক্ত হয়েছে; অনেক ধনীও হয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক মডেল আবারো বদলাচ্ছে, যার পরিণাম এশিয়াসহ বাকি বিশ্বকে প্রভাবিত করবে।
এশিয়ার প্রস্তুতকারক খাতকে বিকশিত ও বিশ্বসেরা করার পেছনে দীর্ঘদিন ধরে অবদান রাখছে আঞ্চলিক বাণিজ্য সংযোগের একের পর এক এক জোয়ার। ১৯৯০ এর দশকে এশিয়ার মোট বাণিজ্যের ৪৬ শতাংশ এশিয়াতেই হতো। ২০২১ সাল নাগাদ যা পৌঁছে যায় ৫৮ শতাংশে। ফলে ইউরোপের পরেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সংযুক্ত মহাদেশে পরিণত হয় এশিয়া।
এশিয়া সম্পদশালী হওয়ার সাথে সাথে এশীয় কোম্পানিগুলো যত শক্তিশালী হচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বিনিয়োগও ততোটাই হয়ে পড়ছে আঞ্চলিক।
গত এক দশকে এশীয় দেশে বিনিয়োগেই বেশি উৎসাহ দেখা গেছে এশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর। এ সময়ে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের থেকে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) যতটা আসে, অন্য এশীয় দেশের থেকে বিনিয়োগ তার দ্বিগুণ গতিতে বাড়ে।
এই পুঁজির সিংহভাগটাই আসে চীন এবং তুলনামূলক বয়স্ক জনসংখ্যার ধনী দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। আর তা পেয়েছে এশিয়ায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও তরুণ জনশক্তির দেশগুলো। এ ধারাবাহিকতায়, ২০২১ সাল নাগাদ এশিয়ায় সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ৫৯ শতাংশ অংশীদারত্ব (হংকং ও সিঙ্গাপুর বাদে) ছিল এশীয়দের হাতেই। একইসময়ে, পশ্চিমাদের অংশে পতন হয়।
আর্থিক লেনদেনের প্রবাহেও একই চিত্র উঠে আসছে। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের আগে আন্তঃসীমান্ত লেনদেনে এশিয়ার অংশ ছিল ৪০ শতাংশ, যা বর্তমানে ৫৪ শতাংশে পৌঁছেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না, জাপানের মিতশুবিশু ইউএফজে ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ ও সিঙ্গাপুরের ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকের মতো বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলে তাদের ঋণ কার্যক্রম প্রসারিত করেছে। একইসময়ে পশ্চিমা ঋণদাতারা পিছিয়ে পড়েছে।
এই অঞ্চলে উন্নয়ন অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা রেখেছে, তার বেশিরভাগটাই করা হয়েছে বহুপাক্ষিক ব্যাংকের মাধ্যমে। সে তুলনায় এশিয়ার সম্পদশালী দেশগুলোই বড় ঋণদাতা, এবং সরাসরি বিনিয়োগেও এগিয়ে। যেমন ২০২৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে চীন প্রতিবছর গড়ে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ/বিনিয়োগ করেছে। তারপরেই আছে দ. কোরিয়া ও জাপান। তাদের বার্ষিক লগ্নী যথাক্রমে ৪ ও ২.৯ বিলিয়ন ডলার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঋণের সাথে কারিগরি দক্ষতা হস্তান্তর করা হয়েছে।
এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে এর প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে। বর্তমানে ভিয়েতনামের হো চীন মিন শহরে যদি যান, দেখতে পাবেন নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন হওয়া দুটি নতুন মেট্রোরেল স্টেশন, যা নির্মিত হয়েছে জাপানের সহায়তায়। সে তুলনায়, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে নির্মিত অবকাঠামোর সংখ্যাই কম।
এশিয়ার এই আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা আরও গভীর হবে এমন সম্ভাবনাই বেশি। আরসেপ বা (রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ)- এর মতোন নতুন বাণিজ্য চুক্তিগুলো আঞ্চলিক বাণিজ্যের বিদ্যমান কিছু বাধা দূর করেছে। এদিকে পণ্য সরবরাহ চক্র আরও জটিল হয়ে ওঠায়, সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা (লজিস্টিকস)-য় আরও আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে, তার বদলে ভারত ও ভিয়েতনামে কারখানা স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ; নতুন লজিস্টিকস অবকাঠামো গড়ে তোলার চাহিদা সামনে আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
এশিয়ার ক্রমবর্ধমান ভোক্তাশ্রেণি আঞ্চলিক সম্পৃক্ততাকে আরও বেগবান করবে। বর্তমানে আন্তঃএশিয়া বাণিজ্যের বেশিরভাগই হয় মধ্যবর্তী পণ্য বা আধা-প্রস্তুতকৃত পণ্যের – যা দিয়ে উৎপাদিত হয় ফিনিশড প্রোডাক্ট। যেমন বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের জন্য কাপড় বানাতে সুতা আমদানি করে, আবার সরাসরি কাপড়ও আমদানি করা হয়। যা দিয়ে চূড়ান্ত পণ্যটি উৎপাদনের পর রপ্তানি করা হয়। সে তুলনায়, আন্তঃএশিয়া বাণিজ্যে সরাসরি ভোগ্যপণ্য বিনিময়ের হার কম। কিন্তু, আগামী পাঁচ বছরে এই অঞ্চলের উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো গড়ে ৪.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে অনুমান করছে আইএমএফ। উন্নত দেশগুলোর চেয়ে তিনগুণ দ্রুত হারে হবে এ প্রবৃদ্ধি। বিকশিত অর্থনীতির সুবাদে ভোক্তারা যত সম্পন্ন হবেন, ততো বেশি প্রতিবেশী দেশ থেকে পণ্য কিনবেন তারা।
আঞ্চলিক সম্পৃক্ততার অর্থনৈতিক তাৎপর্য যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। এটি আঞ্চলিক আয় বৈষম্য কমাতে অবদান রাখতে পারে। বর্তমানে এশীয় দেশগুলোর মধ্যে আয় বৈষম্য ব্যাপক। যেমন ক্রয় ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি বা পিপিপি) ভারতের মাথাপিছু জিডিপি যেখানে ৮ হাজার ডলারের কাছাকাছি, সেখানে জাপানে তা প্রায় ৪৯ হাজার ডলার।
পূর্ব ইউরোপের সাথেও পশ্চিম ইউরোপের আয় বৈষম্য ছিল ব্যাপক। কিন্তু, আঞ্চলিক অন্তর্ভুক্তির পর এই ব্যবধান কমাতে পেরেছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। একইভাবে এশীয় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আয় বাড়বে। ধনী ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ভারে ন্যুজ দেশগুলোর সঞ্চিত পুঁজির সর্বোত্তমগন্তব্য হয়ে উঠেছে দরিদ্র ও তরুণ জনসংখ্যাবহুল দেশগুলো। এই বিনিয়োগ সেখানে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে যেমন অবদান রাখছে, তেমনি ভালো অঙ্কের রিটার্নও দিচ্ছে বিনিয়োগকারীদের।
এই অবস্থায়, বাণিজ্য বাড়লে– ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের দাম কমবে। অন্যদিকে, নতুন বিনিয়োগের ফলে তহবিল পাওয়ার খরচও কমবে।
কিন্তু, এর রাজনৈতিক পরিণতি কী হবে? ইউরোপের মতোন এশিয়ায় গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বয়ে আনেনি। ইউরোপে আরেকটি যুদ্ধ এড়ানোর প্রচেষ্টার ফসল- ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এশীয় দেশগুলোর এমন কোনো তাগিদ নেই। তারা প্রত্যেকেই রাজনৈতিকভাবে প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা; রাজনৈতিক ব্যবস্থাও একে অন্যের থেকে ভিন্ন ভিন্ন। এরমধ্যে উদার গণতন্ত্র থেকে শুরু করে প্রবল স্বৈরাচার –সব ধরনের শাসনব্যবস্থাই রয়েছে। ফলে এশীয় কোনো রাজনৈতিক ইউনিয়ন অবাস্তব। বরং বহুপাক্ষিক একটি ব্যবস্থার উদয় হবে, এ সম্ভাবনাই বেশি। সেখানে এশিয়ার বিভিন্ন শক্তিধর দেশ প্রভাব বিস্তারের জন্য একে-অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করবে।
যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারী, কিন্তু আগামীতে ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খবরদারি বিলীন হবে। এক কথায় বলা যায়, আমেরিকা এরমধ্যেই তার আর্থিক প্রভাব হারাতে শুরু করেছে, ফলে এশিয়ার আসন্ন ব্যাপক প্রবৃদ্ধি থেকে তেমন লাভবান হবে না। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান– উভয় রাজনৈতিক শিবিরেরই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রতি আগ্রহ কমেছে। ফলে আমেরিকা এশিয়ায় যখন জোট গঠনের চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই দেশটির অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের উপায় কমেছে অতীতের তুলনায়।
তার মানে অবশ্য এই নয়, এশিয়ায় চীনের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হবে। চীন আঞ্চলিক হেভিওয়েট হলেও, এ অঞ্চলের অনেক দেশই বেইজিংকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। যেমন বলা যায় ভারত ও ভিয়েতনামের কথা। ভারত পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভারতীয়ও চীনকে পছন্দ করে না। সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম অবশ্য উভয়পক্ষেই ভারসাম্য রেখে চলছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো ধনী দেশ চীনের প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হবে।