ভাবনা-চিন্তার জন্য বিরতি: গাজায় স্থল অভিযানের আগে ইসরায়েলের যত হিসাব-নিকাশ
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকেই ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গাজায় পাল্টা তীব্র হামলা চালানো হচ্ছে। একইসাথে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র বাহিনীটিকে নির্মূল করার লক্ষ্যে গাজায় স্থল অভিযানের পরিকল্পনাও করছে তেল আবিব। খবর বিবিসির।
তারই অংশ হিসেবে ইসরায়েল সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) প্রায় ৩ লাখ রিজার্ভ সৈন্য জড়ো করেছে। গাজা সীমান্তে ট্যাঙ্ক, স্বয়ংকৃত আর্টিলারি সিস্টেম এবং যুদ্ধের পোশাকে হাজার হাজার ভারী সশস্ত্র পদাতিক বাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছে নেতানিয়াহু সরকার।
অন্যদিকে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনী গাজায় হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের প্রতিটি সন্দেহভাজন আস্তানায় ও অস্ত্রাগারে হামলা চালচ্ছে। এতে করে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক লোক আহত ও নিহত হয়েছে। সেইসাথে মারা গিয়েছে অল্প সংখ্যক হামাস সদস্যও।
তবে হতাহতের সকল সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় গত মঙ্গলবার গাজার সেন্ট্রাল হাসপাতালে বোমা হামলার ঘটনা। এই এক ঘটনাতেই হাজারের ওপরে গাজাবাসী আহত ও নিহত হয়েছে। যদিও ইসরায়েল এই দায় অস্বীকার করে উল্টো হামাসের ওপর দোষ চাপিয়েছে। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট যেন আরও তীব্র হচ্ছে।
তবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও ইসরায়েল এখনো গাজায় স্থল অভিযান শুরু করেনি। শেষ পর্যন্ত দেশটি এই অভিযান বাস্তবায়ন করতে পারবে কি-না সেটা নিয়েও তৈরি হয়েছে সন্দিহান। এর পেছনে অবশ্য বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর জড়িত।
বাইডেন ফ্যাক্টর
চলতি সপ্তাহে বাইডেন অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই ইসরায়েল সফর করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফরই প্রমাণ করে যে, উক্ত অঞ্চলের পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কতটা গভীরভাবে চিন্তিত। এক্ষেত্রে মোটাদাগে ওয়াশিংটনের দুশ্চিন্তার মূলত দুইটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অবর্ণনীয় মানবিক সংকট। আর অন্যটি হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলের গাজা দখলের যেকোনো ধরণের সিদ্ধান্ত হবে 'বড় ভুল'। সম্প্রতি সিবিএস নিউজে সাংবাদিক স্কট পেলিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেন তিনি। বাইডেন বলেন, "আমি নিশ্চিত যে, ইসরায়েল যুদ্ধের সকল নিয়ম মেনেই চলবে।"
আনুষ্ঠানিকভাবে বাইডেনের ইসরায়েল সফরের অবশ্য আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এই সফরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই যে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, সেই বার্তা আরও একবার প্রচার করতে চাচ্ছে। একইসাথে চলমান গাজা পরিস্থিতি নিয়ে ইসরায়েলের পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কেও জানতে চাইছে।
অন্যদিকে সফরে অনানুষ্ঠানিকভাবে আরও কিছু বিষয় উঠে আসতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা অনুমান করছেন। এতে বাইডেন সম্ভবত নেতানিয়াহুর কট্টরপন্থী সরকারকে চলমান পরিস্থিতিতে কিছুটা সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন। একইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানতে চাইতে পারে যে, আইডিএফ যদি গাজায় প্রবেশ করে, তবে সেটা কখন এবং কী পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করা হবে।
যথাযথ পরিকল্পনা ও বিমান বাহিনীকে সুচিন্তিতভাবে ব্যবহার না করে যদি ইসরায়েল গাজায় পূর্ণ মাত্রায় সামরিক আগ্রাসন শুরু করে, তবে সেটি ওয়াশিংটন ও তেল আবিব উভয়ের জন্যই বিপদের কারণ হতে পারে।
বাইডেন ঠিক এমন সময় ইসরায়েল সফর করেছে যখন গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালে নির্মম বোমা হামলার ঘটনায় ইসরায়েলকে দোষারোপ করে বিশ্বব্যাপী চলছে সমালোচনার ঝড়। কিন্তু এই ঘটনার তেল আবিবের ব্যাখ্যা এই যে, গাজা থেকে ছোড়া রকেটই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েই ঐ হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। এতে তেল আবিবের সম্পৃক্ততা নেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের এই ব্যাখ্যার সাথেই সুর মিলিয়েছেন।
তবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, ইসরায়েলের বিমান হামলায় ফলে হাসপাতালটি ধ্বংস করা হয়েছে। নিহত হয়েছে শত শত রোগী ও শরণার্থী।
ইরান ফ্যাক্টর
গত কয়েকদিনে ইরান কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, ইসরায়েল স্থল অভিযান চালালে কড়া জবাব দেওয়া হবে। পরিণতি ভোগ করা ছাড়া ইসরায়েলকে গাজা উপত্যকায় কোনো পদক্ষেপ নিতে দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমিরাবদুল্লাহিয়ান।
আমিরাবদুল্লাহিয়ান বলেন, "প্রতিরোধের নেতারা ইহুদিবাদী শাসককে গাজায় কোনো পদক্ষেপ নিতে দেবে না। বিকল্প সকল পথ খোলা রয়েছে। গাজার জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না।"
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী লেবাননের হিজবুল্লাহ; যাদের অবস্থান ইসরায়েলের ঠিক উত্তর সীমান্তে।
গত ১৩ অক্টোবর লেবাননে অবস্থানকালে আমিরাবদুল্লাহিয়ান বলেন, "গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ চলতে থাকলে লেবানন সীমান্তে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট তৈরি হওয়ার 'সব ধরনের সম্ভাবনা' রয়েছে।"
ইসরায়েল ও লেবানন ২০০৬ সালে মারাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল; যাতে ইসরায়েলের আধুনিক যুদ্ধ ট্যাঙ্কগুলি লুকানো মাইন এবং সুপরিকল্পিত অ্যামবুসের কাছে বেশ ধরাশায়ী হয়েছিল। এরপর থেকে হিজবুল্লাহ ইরানের সাহায্যে ধীরে ধীরে পুনরায় সশস্ত্র হয়েছে। এখন ধারণা করা হয় যে, গোষ্ঠীটির কাছে প্রায় দেড় লাখ রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকগুলি দূরপাল্লার এবং নির্দিষ্ট স্থানে অনেকটা নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।
এমতাবস্থায় ইসরায়েল যদি গাজা আক্রমণ করে তবে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে যুদ্ধের একটি নতুন ফ্রন্ট খুলতে পারে। এতে করে ইসরায়েলকে গাজায় হামাসের পাশাপাশি নতুন আরেকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে বাধ্য করবে।
বর্তমানে ইসরায়েলের সাথে লড়াইয়ের জন্য হিজবুল্লাহ অনেকটা প্রস্তুত রয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ইসরায়েলের সাহায্যে ভূমধ্যসাগরে অবস্থানের ঘোষণার পর এই আশঙ্কা যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে ইসরায়েলের জন্য আশার ব্যাপার এই যে, হিজবুল্লাহর যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণে মার্কিন নৌ-বিমান থেকে পাল্টা প্রতিরোধ করা সহজতর হবে। যদিও এটিও মনে রাখতে হবে যে, ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধের শুরুতে প্রতিপক্ষ অত্যাধুনিক জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলি যুদ্ধজাহাজকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল।
মানবিক ফ্যাক্টর
হামাসের হামলার পর থেকে গাজায় অনবরত বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। একইসাথে হামাসকে নির্মূল করতে স্থল অভিযানের প্রস্তুতিও নিচ্ছে দেশটি। কিন্তু চলমান সংঘাতে গাজার প্রচুর বেসামরিক নাগরিক হতাহতের ঘটনা করছে। এক্ষেত্রে বিশ্বের বহু দেশই ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সমর্থন সরিয়ে নিচ্ছে।
একইসাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিমান হামলা বন্ধ করে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ও জীবন রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছে। এমতাবস্থায় এতসব কিছু উপেক্ষা করেও যদি ইসরায়েল স্থল অভিযানে যায়, তবে হতাহতের সংখ্যা আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
ইসরায়েলের বহু সেনাও অ্যাম্বুশ, স্নাইপার এবং বুবি ফাঁদে নিহত হবে। এছাড়াও আইডিএফের হামাসের গড়ে তোলা হাজার হাজার কিলোমিটারের টানেলকেও মোকাবিলা করতে হবে। পরিশেষে সামরিক-বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে দিয়ে মানবিক পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।
বিশাল গোয়েন্দা ব্যর্থতা
গোয়েন্দা দক্ষতার জন্য ইসরায়েলের পৃথিবীজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। তবে সম্প্রতি হামাসের হামলায় যেন সেই ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দেশটির স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত হামাসের আচমকা হামলার তথ্য যোগাড়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। যদিও সংস্থাটির গাজার অভ্যন্তরে গুপ্তচরদের একটি বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের কমান্ডারদের উপর করা নজরদারি করে থাকে।
এক্ষেত্রে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলাকে ১৯৭৩ সালে ইওম কিপুর যুদ্ধের পর থেকে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এই ঘটনার পর থেকে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা গত ১০ দিন ধরে জিম্মিদের নাম এবং অবস্থান সনাক্ত করার চেষ্টা করছে। একইসাথে হামাস কমান্ডাররা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে, সেটিও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
ধারণা করা হচ্ছে যে, তথ্য সংগ্রহের জন্য ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আরও বেশ কিছু সময় নিচ্ছে। যাতে করে দেশটি গাজায় স্থল অভিযান পরিচালনা করলে সেখানকার ধ্বংসাবশেষে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর পরিবর্তে সরাসরি কাঙ্ক্ষিত নির্দিষ্ট স্থানে দ্রুত যেতে পারে। যদিও ইসরায়েলের এমন পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নিঃসন্দেহে নিন্দার ঝড় উঠবে।
একইসাথে ইসরায়েলের ক্রমাগত বিমান হামলার পরেও হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের একটা বড় অংশ এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা ইসরায়েলি সৈন্যদের জন্য নিশ্চিতভাবে পথে পথে ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে। এছাড়াও ভূগর্ভস্থ টানেলগুলি আইডিএফের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই ইসরায়েলি গোয়েন্দারা সেইসবের অবস্থান খুঁজে বের করতে এবং সেই অনুযায়ী আইডিএফকে সতর্ক করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।