ব্যবসায়িক খাতে বড় সম্ভাবনা রয়েছে জেনারেটিভ এআই’র
২০২২ সালের শেষদিকে চালুর পর দ্রুতই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে চ্যাটজিপিটি। দুই মাসের মাথায় বিনোদনের উদ্দেশ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষ চ্যাটজিপিটির প্রতি প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিতে লাগলেন। গুগলেও তখন 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা' লিখে অনুসন্ধান চালানোর হিড়িক পড়ে গেল।
এসব দেখে বিনিয়োগকারীরা নতুন উৎসাহ পেলেন এআই খাতে অর্থ ঢালতে। কিন্তু দিনশেষে এআই-এর যে সম্ভাবনার ওপর বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন, তা মূলত প্রযুক্তিটির ব্যবসায়িক ব্যবহারেই জড়িয়ে আছে। ব্যবসায়িক দুনিয়ায় এআই আগের যেকোনো উদ্ভাবনের চেয়ে দ্রুত গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, এ আত্তীকরণ রাতারাতি ঘটবে।
এআই-এর সম্ভাবনার কথা ভাবলে উল্লাসিত হতে হয় বৈকি। ম্যাককিন্সি কনসালটেন্সির তথ্যমতে, জেনারেটিভ এআই-এর ব্যবসায়িক ব্যবহারের তিন-চতুর্থাংশ পড়বে চারটি শ্রেণিতে: গ্রাহক পরিচালনা, মার্কেটিং ও বিপণন, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং গবেষণা ও উন্নয়ন। এআই-এর কল্যাণে কর বিষয়ক জটিল কোনো নথিতে অনুসন্ধান চালানো বা আইনি কোনো কাগজপত্রের সারাংশ তৈরি করা খুব সহজেই সম্ভব হতে পারে। একট প্রম্পট লেখার দেরি; সঙ্গে সঙ্গেই আপনার হাতে মার্কেটিংয়ের খসড়া চলে এল।
ইতোমধ্যে অনেক কোডার সফটওয়্যার লেখার কাজে সহায়তার জন্য মাইক্রোসফটের কোপাইলটের ওপর ভরসা করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, গড়পড়তা কম পারফরম্যান্সের পেশাদার কর্মীরা জেনারেটিভ এআই থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিতে পারেন। এর ফলে যেকোনো ফার্মের কাজের আউটপুটে বড় প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
আশা করা যায়, অতীতের বিভিন্ন প্রযুক্তির তুলনায় অনেক জেনারেটিভ এআই টুল ব্যবহার করতে পারা সহজ হবে। এটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের সূচনার মতো নয় যেখানে কর্মীদের একাধিক হার্ডওয়্যার কেনার দরকার হতো, বা ই-কমার্সের মতো নয় যেখানে অনলাইনে দোকান খোলার আগে বিক্রেতাকে আদত দোকান খুলতে হতো।
অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই সুনির্দিষ্ট কোনো টুল তৈরির জন্য এআই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করাটাকেই উপযুক্ত মনে করতে পারে। মাইক্রোসফট ও গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে তাদের বিভিন্ন অফিস সফটওয়্যারে এআইকে জুড়ে দিতে শুরু করেছে। অর্থাৎ খুব শীঘ্রই সাধারণ ব্যবহারকারীরাও এসব এআই টুলের সুবিধা নিতে পারবেন।
বড় বড় অনেক কোম্পানি ইতোমধ্যে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছে। মর্গান স্ট্যানলি নামক একটি ব্যাংক সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কাজে সহায়তার জন্য টুল তৈরি করতে এআই ব্যবহার করছে। 'স্বয়ংক্রিয় ল্যাব' পরিচালনাকারী একটি স্টার্টআপের সঙ্গে সম্ভাবনাময় অণু অনুসন্ধানের জন্য একটি চুক্তি করেছে এলি লিলি নামক একটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান। এলি লিলি এসব অণুর বিকাশ ঘটাবে, পরীক্ষা ও বাজারজাত করবে।
২০২০ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মার্কিন ব্যাংকগুলোর প্রকাশ করা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৫ শতাংশে কাজের বিবরণ অংশে এআই-এর কথা উল্লেখ ছিল। ২০২০–২২ সালে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেওয়া পেটেন্টগুলোর প্রায় ৮ শতাংশ ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত।
এতকিছু সত্ত্বেও সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এআই গ্রহণ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাবে না। প্রযুক্তি দুনিয়ার বাইরে কেবল এক-তৃতীয়াংশ ব্যবস্থাপক কাজের জন্য নিয়মিত জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করেন বলে ম্যাককিন্সির বরাতে জানা গেছে। প্রায় অর্ধেক ব্যবস্থাপক ইতোমধ্যে এআই প্রযুক্তি পরীক্ষা করে দেখেছেন, কিন্তু ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এক-পঞ্চমাংশ কখনোই এআই প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসেননি।
এআই প্রযুক্তির নানা বাধা, এটি নিয়ে থাকা বিভ্রান্তির কারণে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এটিকে নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে। চ্যাটবটগুলোর মধ্যে তথ্য তৈরি করার প্রবণতা অনেক বেশি। আর এ নির্মাণ বিপজ্জনকভাবে বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয় প্রায় সময়েই। এছাড়া লেখক, শিল্পী, ফটোগ্রাফার ও প্রকাশকেরা তাদের তথ্য ব্যবহারের জন্য এআই মডেলের বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছেন। এআই ব্যবহারের আইনি ঝুঁকি নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান উদ্বিগ্ন। জেপিমরগ্যান চেজ (একটি ব্যাংক) চ্যাটজিপিটি'র ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে, যদিও অন্য কিছু খাতে এটি এআই নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে।
আবার কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এ যাত্রায় একদমই অংশ নিতে ইচ্ছুক নয়। প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে স্থবিরতা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করলেও ২০০০-এর দশকের শেষের আগ পর্যন্ত মার্কিন কোম্পানিগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের কোনো ওয়েবসাইট ছিল না। অনেক কোম্পানিই এখনো সেকেলে ব্যবস্থায় পড়ে রয়েছে। সরকারি খাতসমূহ এবং অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত শিল্প খাতে উদ্ভাবনের প্রচেষ্টার বালাই নেই। আর এ খাতগুলোও কিন্তু অর্থনীতির বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে।
কর্মীদের পক্ষ থেকেও এআই ব্যবহারের অনীহা তৈরি হতে পারে। প্রযুক্তির কল্যাণে ক্লান্তিকর কাজগুলো সহজে করা গেলেও অনেকেই মনে করেন চূড়ান্তভাবে এ প্রযুক্তি তাদের চাকরি দখল করে নেবে। একটি কনসালটেন্সি ফার্মের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোম্পানির সম্মুখভাগে থাকা কর্মীরাই ম্যানেজারদের তুলনায় জেনারেটিভ এআই নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ও নৈরাশ্যবাদী। কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তি গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ধীর করার জন্য কাজ করতে পারে শ্রম ইউনিয়নগুলোও।
তাহলে এআই নিয়ে আগ্রহী একজন বস প্রযুক্তি নিয়ে কীভাবে ভাববেন? কোনো কোম্পানি সোৎসাহে এআই-এর দিকে যাবে না-কি এআই থেকে দূরে থাকবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ঠান্ডা মাথায় এআই-এর মতো এখনো নতুন ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে মূল্যায়ন করলে ক্ষতি নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনার কর্মীদেরও এ যাত্রায় স্বেচ্ছায় অংশ নিতে হবে। তাই তাদের আশঙ্কার ক্ষেত্রগুলোর দিকে মনোযোগ দিন এবং নতুন কিছু নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার আনন্দের বিষয়ে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করুন।
রচনা সম্ভোগ: বিজনেস অ্যাফেয়ার্স এডিটর, দ্য ইকোনমিস্ট
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।