পৃথিবী ও মঙ্গলের পরিণতি কী হবে যদি সৌর বায়ু না থাকে?
ঘণ্টায় কয়েক মিলিয়ন মাইল গতিবেগে সূর্য প্রতিনিয়ত গ্যাস ও ইলেক্ট্রিক কণা মহাকাশে নিঃসরণ করছে। নিঃসৃত এই প্রবাহকে সৌর বায়ু বলা হয়, যা মহাকাশের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষার পাশাপাশি আকাশে সুন্দর অরোরা বা নর্দান লাইট সৃষ্টি করে। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে একদিন পৃথিবী ও মঙ্গলের কাছাকাছি আসার সাথে সাথেই আচমকা এটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
সম্প্রতি জার্নাল অভ জিওগ্রাফিক্যাল রিসার্চ: স্পেস ফিজিক্স-এর একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যখন সৌর বায়ু দুর্বল হয় তখন পৃথিবীর বাইরের চুম্বকীয় আবরণ বা ম্যাগনেটিক লেয়ারও অপ্রত্যাশিতভাবে প্রসারিত হয়ে যায়।
সৌর বায়ুর কারণে মঙ্গলের এই চুম্বকীয় স্তরের পরিবর্তনের সূত্র ধরে জানা যাবে কেন বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গলের পানি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর জন্য সৌর বায়ু নিয়ে জানা তো আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা যোগাযোগ ব্যবস্থা ও স্যাটেলাইটের ওপরও প্রভাব রাখে।
মঙ্গলের ওপর সৌর বায়ুর প্রভাব
প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গলের পৃষ্ঠে খাল, নদী ও সাগর থাকলেও সময়ের সাথে সাথে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহের চারপাশে সৌর বাতাসের এই বিচিত্র বৈশিষ্ট্যগুলো অন্বেষণ করছেন যা তাদের এই বিলুপ্তের কারণ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।
তবে বিজ্ঞানীরা এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের ওপর সৌর বায়ুর একটি শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। তারা জানান, বিলিয়ন বছর আগে সৌরকণা এবং অতিবেগুনি রশ্মির অবিরাম প্রবাহ মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলকে অনেকখানি দুর্বল করে ফেলে। এই দুর্বল চুম্বকীয় স্তরের কারণেই হয়তো পানির মতো বিভিন্ন আয়নিক কণা মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ পদার্থবিদ শ্যানোন ক্যারি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'পানির তরল আকারে স্থিতিশীল থাকতে হলে পর্যাপ্ত বায়ুমণ্ডলীয় চাপ থাকতে হবে। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল ক্ষয় হওয়ার পর পানি জলীয়বাষ্প হয়ে মহাকাশে হারিয়ে যায়।'
কীভাবে সৌর কণা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলকে ক্ষয় করছে তা জানতে গত ১০ বছর ধরে নাসা'র 'মার্স অ্যাটমোসফিয়ার অ্যান্ড ভোলাটাইল এভ্যুলেশন (মাভেন)' পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, অতিরিক্ত সৌর বায়ুর কারণেই বেশিরভাগ কণিকা বা আয়ন মঙ্গলের পৃষ্ট থেকে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মঙ্গলে ঠিক কখন এই সৌর বায়ু অনুপস্থিত ছিল, তা এখনো তারা নির্ণয় করতে পারেননি।
ডিসেম্বরের ২৬ তারিখের দিকে মহাকাশযান মাভেন মঙ্গলে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করে। একটি নতুন পরীক্ষায় দেখা যায়, মঙ্গলের সৌর বায়ুর ঘনত্ব প্রায় ১০০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর সৌর বায়ুর চাপ সংকোচিত না হয়েই মঙ্গলের চুম্বকীয় স্তর প্রায় হাজার কিলোমিটারে বর্ধিত হয়।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশবিজ্ঞানী এবং লেখক জেসপার হেইলকাস জানান, ঘনত্ব হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ দুটি সৌর বায়ুর পরস্পরমুখী সংঘর্ষ। দ্রুতগতিতে থাকা সৌর বায়ু একটি বেলচার মতো কাজ করে এবং অপর দুর্বল সৌর বায়ুকে সরিয়ে নিজে ওই জায়গা দখল করে। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল এর পরের দিনই তার স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসে। হেইলকাস আরও জানান, এর আগেও কম ঘনত্বের সৌর বায়ুর দেখা পেয়েছে পৃথিবী কিন্তু এবারেরটা সবচেয়ে দীর্ঘ ও বেশ নাটকীয় ছিল।
পৃথিবীর ওপর প্রভাব
মঙ্গলের পর ২০২২-এর ডিসেম্বরে সৌর বায়ু পৃথিবীতে আঘাত হানে। হেইলকাস জানান, পৃথিবীর ওপর সৌর বায়ুর প্রভাব কমার সাথে সাথে নাসা'র আরেকটি অভিযান শুরু হয় আমাদের গ্রহেন বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করার জন্য। পর্যবেক্ষণে জানা যায়, পৃথিবীর শক ওয়েভ (যাকে বো ওয়েভও বলা হয়) আগের থেকে দুই গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু এই প্রথম এই নাটকীয় সৌর বায়ুর সম্মুখীন হয়নি পৃথিবী। এর আগে ২০০৯ সালেও প্রায় চার গুণ বড় বো ওয়েভ পৃথিবীতে আঘাত হানে। একদল গবেষক জানান, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ওপর দিয়ে প্রায় ১২টি কম ঘনত্বের সৌর বায়ু বয়ে গেছে। এর বেশি হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। আগে এরকম ঘটনা নিয়ে কাজ করা রেডিও মহাকাশচারী জনার্ধন পদ্মনাভ জানান, তিনি ২২ ডিসেম্বরের ঘটনা নিয়েও অনুসন্ধান চালাবেন। ভারতের ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির বিজ্ঞানী পদ্মনাভ বলেন, 'এই ঘটনার সময় পুরো পৃথিবী একটি নিম্ন ঘনত্বের বুঁদবুদ বা বাবলে আচ্ছন্ন ছিল।'
বিজ্ঞানীরা মূলত সৌর বায়ু কীভাবে পৃথিবীর দিকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে ধেয়ে আসে তা নিয়ে জানতে বেশি আগ্রহী। এই সৌর কণাগুলো আমাদের প্রতিরক্ষামূলক চুম্বকীয় স্তরের সাথে সাংঘর্ষিক আচরণ করে। যার ফলে সুন্দর নর্দান লাইট সৃষ্টি বা রেডিও ব্ল্যাকআউট যেমন হতে পারে তেমনি ঘটাতে পারে স্যাটেলাইট ব্যবস্থায় ব্যাঘাত।
তবে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ পদার্থবিদ রায়ান ডিউই জানান, নিম্ন ঘনত্বের সৌর বায়ু দ্বারাও পৃথিবী একই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে। কারণ, নিম্ন ঘনত্বের সৌর বায়ু বয়ে যাওয়ার সময় পৃথিবীর রেডিয়েশন বেল্ট (বিকিরণ বেষ্টনী) সহ এর চুম্বকীয় স্তর প্রসারিত হতে থাকে। বিলিয়ন সংখ্যক উচ্চ শক্তির কণা মিলে এই রেডিয়েশন বেল্ট গঠিত, যেটি পৃথিবীকে সকল ক্ষতিকর শক্তিকণা থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এই রেডিয়েশন বেল্ট যদি জিপিএস স্যাটেলাইট এর ওপর চলে আসে তাহলে মহাকাশযানগুলোর সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়বে।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ ও প্লাজমা পদার্থবিদ এলিসন জেইন্স বলেন, 'এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বেতার তরঙ্গের ওপর প্রভাব রাখে এবং যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি করে।' তবে জেইন্সের মতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সৌর বায়ুরও প্রয়োজন আছে। সৌর বায়ুর অভাবে ১৯৯৯ সালের মে মাসে অস্বাভাবিক প্লাজমা বৃষ্টি হয়েছিল। যার কারণে সৌর কণাগুলো সরাসরি পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে প্রবেশ করে।
স্যাটেলাইট অপারেটররা জানান, মহাকাশের বাধাহীন পথের কিছু খারাপ দিকও আছে। অতিরিক্ত কণাগুলো বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে যা পুরো স্তরকে প্রসারিত করে এবং স্যাটেলাইটগুলোর গতি হ্রাস করে নিজের দিকে টেনে নেয়।
পদ্মনাভ জানান, মহাকাশে অতিরিক্ত খালি জায়গা পৃথিবীর সৌর হুমকিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। করোনাল ম্যাস ইজেকশন-এর মতো শক্তিশালী সৌর অগ্ন্যুৎপাত হলে পৃথিবীর রেডিও, রেল, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সাথে স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থারও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এছাড়াও তিনি বলেন, 'সৌর বায়ু ঘটার সময় যদি এরকম একটি করোনাল ম্যাস ইজেকশন পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে তাহলে আপনাদের ধারণাও নেই তা কী পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে।'