চ্যাটজিপিটির আড়ালে: অজ্ঞাত ডিজিটাল শ্রমিকদের না বলা গল্প
আপনি চ্যাটজিপিটির কমান্ড বক্সে কোনো নির্দেশনা (প্রম্পট) দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করছে আপনার জন্য। আপনার জন্য গানের লিরিক্স লিখে দেওয়া হোক কিংবা আপনার ওয়েবসাইটের জন্য প্রোগ্রামিং কোড; কিবোর্ডের একটি বাটনের চাপে মুহূর্তের মধ্যে চ্যাটজিপিটি আপনার জন্য তা করে দিচ্ছে। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে আপনার কাছে জাদু মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনে আদতে রয়েছে মানুষেরই অবদান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের এই জায়গায় এসেছে। আগে যেসব জিনিস শুধু সায়েন্স ফিকশনে দেখা যেত, তা আজ প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অনেকটাই বাস্তব।
তবে চ্যাটজিপিটির এই দুর্বার অগ্রগতি সবার কাছে অনেক প্রশংসিত হলেও আড়ালে থেকে যান এর পেছনে থাকা মানুষেরা। এবং এরা হলেন 'রিমোট লেবার ফোর্স' বা 'দূরবর্তী শ্রমশক্তি'। রিমোট লেবার ফোর্স দ্বারা এমন ব্যক্তিদের বোঝায় যারা গতানুগতিক কর্মস্থলের বদলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের সুবিধামতো জায়গায় বসে কাজ করেন।
মূল্য শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদান সবসময় উপেক্ষিত থেকে যায়। বাংলাদেশের 'রানা প্লাজা' দুর্ঘটনার দিকেই যদি তাকাই, ওই দুর্ঘটনায় হাজারের বেশি পোশাক শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। তাদের এই করুণ মৃত্যু এখনও মানুষের মনে নাড়া দেয়।
তৈরি পোশাক শিল্প ও ডিজিটাল শিল্পের মধ্যে কিছুটা মিল রয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পোশাক শ্রমিকরা কর্মরত অবস্থায় শারীরিক ঝুঁকির সম্মুখীন হন। ডিজিটাল শিল্পে ঝুঁকিটা বেশি মানসিক।
খুন, আত্মহত্যা, যৌন নিপীড়ন বা শিশু নির্যাতন সম্বলিত ভিডিও বা আধেয়সমূহ ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রকাশ করা হয় না। এজন্য প্রতিটি প্লাটফর্মের একটি মডারেটর টিম থাকেন যারা এ ধরনের স্পর্শকাতর আধেয়গুলোর পর্যালোচনা করেন এবং তা প্রকাশের অনুপযোগী হলে বাদ দেন।
ডিজিটাল দুনিয়ার এ শ্রমিকরা টানা বিরক্তিকর, পাশবিক, একঘেয়ে ডিজিটাল কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করতে করতে একসময় মানসিক চাপ অনুভব করা শুরু করেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে একই কাজ করতে থাকায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতি বেশিরভাগ সময়ই তাদের একা মোকাবিলা করতে হয়। তাছাড়া সঠিক দিকনির্দেশনা, আইন না থাকায় অনেকেই কম বেতনে বা অবৈতনিক কাজ করেন, এক ধরনের শোষণ ও অপব্যবহারের শিকার হন তারা।
ডিজিটাল দুনিয়ার এ শ্রমিকেরা ইতোমধ্যে তাদের অধিকার রক্ষার জন্য ইউনিয়ন বা সমিতি গঠন করেছেন। কিন্তু এটি যথেষ্ট হবে না। এটি একটি নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। তাই এআই'র সাথে জড়িত সকল শ্রমিকদের ন্যায্যতা এবং যথাযথ আচরণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়ম।
নৃবিজ্ঞানী ম্যারি গ্রে এসব ডিজিটাল শ্রমিকদেরকে 'ঘোস্ট ওয়ার্কার' বা 'বেনামি/অজ্ঞাত শ্রমিক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পর্দার আড়ালে থাকা এ শ্রমিকেরা দূরবর্তী স্থানে বসে কাজ করেন এবং বিভিন্ন এআই মডেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন যাতে এগুলো আরও ভালো কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে। শুধু প্রাপ্ত বয়স্ক নয়, এদের মধ্যে অনেক শিশুও আছে।
সিলিকন ভ্যালিতে কর্মরত কোনো ব্যক্তি যেখানে ৩০ বছরের আগেই কোটিপতি হওয়ার সম্ভাবনা রাখেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে এটি ঠিক উল্টো। পাকিস্তানের ১৫ বছর বয়সি কিশোর হাসান, টোলোকার মতো প্লাটফর্মের ডেটা অ্যানোটেশনের কাজ করে ঘণ্টাপ্রতি দুই ডলারেরও কম উপার্জন করে। তার মতো অনেক কম বয়সি শিশুরা এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত মানসিকভাবে কঠিন কাজ করে। কিন্তু শিশুশ্রমের এই বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে দেখা যায় না।
ডেটা সংগ্রহ এবং ট্যাগ করার জন্য বিশ্বব্যাপী বাজার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে প্রায় ৩০ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধির হারসহ এর বাজার মূল্য আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে যাবে।
অ্যামাজন মেকানিক্যাল টার্ক, অ্যাপেন, ক্লিক ওয়ার্কার, মাইক্রো ওয়ার্কার, পিপল পার আওয়ার, সয় ফ্রিল্যান্সারের মতো কোম্পানিগুলো অন্যায্য শ্রম অনুশীলনের জন্য সমালোচিত হয়েছে। এটি মোকাবিলা করার জন্য গ্লোবাল পার্টনারশিপ এআই ফেয়ার ওয়ার্ক প্রকল্পের অধীনে, এআই (জিপাই), কোম্পানি 'সামা'র সাথে এক বছরব্যাপী একটি অংশীদারিত্ব করেছে। তারা আফ্রিকায় 'সামা'র কার্যক্রমের নিরীক্ষা ও উন্নতি করেছে। এই স্বেচ্ছাসেবী সহযোগিতার লক্ষ্য চার হাজারেরও বেশি কর্মীকে উপকৃত করা।
এই পরিবর্তনগুলো দায়িত্বশীল অনুশীলনের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করার ক্ষমতা প্রদর্শন করে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মার্ক গ্রাহাম বলেছেন যে, প্রযুক্তি সমাজ এবং শ্রম বাজারকে রূপান্তরিত করে, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে পর্দার আড়ালে লক্ষাধিক স্বল্প বেতনের কর্মী রয়েছেন যারা ডেটা সেটগুলোকে আকার দিচ্ছেন, অ্যানোটেশনের কাজ করছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উৎপাদন নেটওয়ার্কের সকল শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম ন্যায্য শ্রমমান প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
ভোক্তারা টেক্সটাইল শিল্পে যেমন আরও ভালো শ্রম অনুশীলনের দাবি করেছেন, আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতেও একই রকম উন্নতি দরকার। এটি অর্জনের জন্য আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী নিয়ম তৈরি করতে হবে যা শ্রমিকদের ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করবে এবং দুর্বল ব্যক্তিদের ওপর শোষণ বন্ধ করবে। উভয় শিল্পেই একটি স্পষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবধান রয়েছে, যেখানে দরিদ্র দেশগুলোর শ্রমিকেরা ধনী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম বেতন পায়। অন্যায্য শোষণ এড়াতে হলে এই অর্থনৈতিক ব্যবধান বন্ধ করতে হবে।
তাই আমাদের অবশ্যই এমন একটি পথ বেছে নিতে হবে যা এই অমানবিক শোষণের পতন ঘটাবে এবং একটি ন্যায্য ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর এই পরিবর্তনের জন্য আমাদের প্রয়োজন স্বচ্ছতা, ন্যায্য শ্রম অনুশীলন এবং সম্মত মানদণ্ড। বিকাশমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিল্পকে টেক্সটাইলের মতো সেক্টরে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। শুধু উদ্ভাবন নয়, কর্মশক্তির মর্যাদা ও কল্যাণকেও অগ্রাধিকার দেওয়া অপরিহার্য।