জেফরি এপস্টেইন: আদালতের নথিতে নাম এলো প্রিন্স অ্যান্ড্রু ও ক্লিনটনের
জেফরি এপস্টাইনের যৌন নিপীড়নে জড়িত থাকার নতুন কিছু নথি প্রকাশ করেছেন মার্কিন আদালত। নথিগুলোতে তার সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় উঠে এসেছে প্রিন্স অ্যান্ড্রু, বিল ক্লিনটনসহ আরও অনেক সুপরিচিত ব্যক্তিদের নাম। খবর বিবিসির।
অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও নারী পাচারের ঘটনায় অভিযুক্ত এই পুঁজিপতি এপস্টাইনকে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে নিউ জার্সি বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরই কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। প্রাথমিকভাবে আদালতের কাছে মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি গোপন থাকলেও গত বুধবার এপ্সটাইনের প্রেমিকা ঘিস্লাইনে ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মার্কিন বিচারক এই রেকর্ডগুলো প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন।
নথিতে উল্লিখিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নামগুলোর মধ্যে মাইকেল জ্যাকসন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেভিড কপারফিল্ডের নামও রয়েছে। যদিও তাদের কেউই অবৈধ কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত নয়। তবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তারকাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাজে লাগিয়েই জেফরি তার যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতেন।
প্রকাশিত ৯০০ পৃষ্ঠার এ নথি এপস্টাইন সম্পর্কে কোনো উল্লেখযোগ্য নতুন তথ্য উদঘাটন করে না। তবে আশা করা হচ্ছে মামলার অতিরিক্ত নথি শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে। উল্লিখিত নথিতে থাকা শতাধিকেরও বেশি ব্যক্তির মধ্যে, কেউ কেউ অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন, কেউ আবার সম্ভাব্য সাক্ষী হিসেবে আছেন।
নথিগুলো প্রকাশের আদেশ দেওয়ার সময় নিউইয়র্কের বিচারক লরেটা প্রেসকা বলেছিলেন, নামধারীদের মধ্যে অনেক নামই ইতিমধ্যে গণমাধ্যম ও ম্যাক্সওয়েলের ফৌজদারি বিচারে চিহ্নিত হওয়ায় জনসম্মুখে চলে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, আরও অনেকে নথি প্রকাশের বিষয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি। তবে বিচারক প্রেসকা জানান, যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় রক্ষা করতে কিছু নাম সংশোধন করা হবে।
নথিতে জোহানা সোজবার্গের উল্লেখ রয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, প্রিন্স অ্যান্ড্রু ২০০১ সালে এপস্টাইনের ম্যানহাটনের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে একটি সোফায় বসে তার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়েছিলেন। তবে বাকিংহাম প্যালেস জোহানার অভিযোগগুলো 'স্পষ্টভাবে অসত্য' বলে জানিয়েছে।
ইতিমধ্যেই রিপোর্ট করা একটি জবানবন্দিতে মিসেস সোজবার্গ অভিযোগ করেছেন যে, প্রিন্স অ্যান্ড্রু তার স্তনে হাত রেখেছিলেন অন্য অভিযুক্ত ভার্জিনিয়া গিফ্রের সাথে একটি ছবির জন্য পোজ দেওয়ার জন্য।
মিসেস জেফ্রি অভিযোগ করেন, ১৭ বছর বয়সে প্রিন্স অ্যান্ড্রু তাকে যৌন নির্যাতন করেন। এ অভিযোগের বিপরীতে ২০২২ সালে ব্রিটিশ রাজকুমার মামলার নিষ্পত্তির জন্য মিলিয়ন অর্থ প্রদান করেছিলেন।
তবে প্রিন্স অ্যান্ড্রু দাবি করেন, তিনি কখনও মিস জিফ্রের সাথে দেখা করেননি। তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা।
আদালতের নথিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের নামও রয়েছে। যদিও তার কোনো অপরাধের উল্লেখ নেই। তবে ২০১৯ সালে জারি করা একটি বিবৃতিতে তার প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি এপস্টাইনের অপরাধ সম্পর্কে 'কিছুই জানেন না'।
রেকর্ড অনুসারে, মিসেস সোজবার্গ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, এপস্টেইন একবার তাকে বলেছিলেন, মি. ক্লিনটন 'কম বয়সী মেয়েদের পছন্দ করেন'। উল্লেখ্য, মি. ক্লিনটন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ২২ বছর বয়সী হোয়াইট হাউস ইন্টার্নের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন।
ফাইলগুলোতে ম্যাক্সওয়েলের সাক্ষ্যও রয়েছে যা নিশ্চিত করে যে, মি. ক্লিনটন এপস্টাইনের ব্যক্তিগত জেটে ভ্রমণ করেছিলেন।
মি. ক্লিনটন ২০০০ সালের শুরুর দিকে আফ্রিকায় দাতব্য কাজে ভ্রমণের অংশ হিসেবে এপস্টাইনের বিমানে ভ্রমণ করেন। সেই সময় ক্লিনটন, এপস্টাইনকে একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জনহিতৈষী হিসাবে প্রশংসা করেছিলেন। যদিও বলেছিলেন যে, তিনি পরে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।
২০১৯ সালের বিবৃতিতে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেছেন যে, তার দাতব্য সংস্থা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের কর্মী এবং সমর্থকরা এই সফরে তার সাথে ছিলেন। বিবৃতিতে স্পষ্ট করা আছে যে, 'তার সিক্রেট সার্ভিসের দল প্রতিটি ভ্রমণে প্রতিটি ক্ষণে তার সাথে ছিল'।
আদালতের নথির একটি অংশ থেকে জানা যায়, ম্যাক্সওয়েলের আইনজীবী একটি মিডিয়া রিপোর্টকে মিথ্যা প্রমাণ করার লক্ষ্যে বলেছিলেন যে, অফিস ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে, মি. ক্লিনটন ক্যারিবিয়ান এপস্টাইনের ব্যক্তিগত দ্বীপে গিয়েছিলেন।
অন্যদিকে ম্যাক্সওয়েলের অ্যাটর্নি বলেছেন যে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট 'প্রকৃতপক্ষে, ১ জানুয়ারি, ২০০১ এবং ১ জানুয়ারি, ২০০৩ এর মধ্যে লিটল সেন্ট জেমস দ্বীপে ভ্রমণ করেননি বা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না'।
আইনজীবী আরও উল্লেখ করেছেন যে, দাবিটি সত্য হলে, সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের 'ভ্রমণ লগ' জমা দিতে হবে। নথিতে মিস সোজবার্গের সাক্ষ্যও রয়েছে যে, এপস্টাইন তাকে বলেছিলেন যে, তিনি তার নিউ জার্সির একটি ক্যাসিনোতে যাওয়ার পথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে যোগাযোগ করবেন।
তিনি বলেন, "জেফরি বলেছেন, 'দারুণ, আমরা ট্রাম্পকে কল করব"। এছাড়া পাইলটরা তাকে বলেছিলেন যে, তাদের বিমান নিউইয়র্কে অবতরণ করতে পারবে না এবং নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটিতে থামতে হবে।
নথিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। মিসেস সোজবার্গকে জবানবন্দির এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, তিনি কখনও মি. ট্রাম্পকে মালিশ করে দিয়েছিলেন কি-না? উত্তরে তিনি তা নাকচ করে দেন।
তিনি আরও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি এপস্টাইনের মাধ্যমে সংগীতশিল্পী মাইকেল জ্যাকসন এবং জাদুকর ডেভিড কপারফিল্ডের সাথে দেখা করেছিলেন। যদিও তিনি তাদের দ্বারা কোন অন্যায়ের অভিযোগ করেননি।
ফরাসি মডেলিং এজেন্ট জিন-লুক ব্রুনেল, যিনি ২০২২ সালে প্যারিস জেলে, ধর্ষণের অভিযোগের মামলা চলাকালীন সময় আত্মহত্যা করেছিলেন, তার নামও একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্রুনেলের জবানবন্দিতে মিসেস গিফ্রে বলেছেন যে, তাকে নিউ মেক্সিকো গভর্নর বিল রিচার্ডসনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। গত বছর তার মৃত্যুর আগে, মি. রিচার্ডসন মিসেস জিফ্রের সাথে কখনও দেখা করার কথা অস্বীকার করেছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি।
নথি অনুসারে, ২০১৫ সালে মারা যাওয়া রদ্রিগেজকে, স্কুলের মেয়েদের এবং এপস্টাইনের জন্য নিয়োগে সহায়তাকারীদের দেওয়ার জন্য সর্বদা নগদ অর্থ বহন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
রবার্ট ম্যাক্সওয়েলের কন্যা, ঘিস্লাইনে ম্যাক্সওয়েল এপস্টাইনের যৌন নির্যাতনে সাহায্যের অভিযোগে ২০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। গত বুধবার সিএনএন-এর উদ্ধৃত একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তার আইনজীবীরা সাজাটির বিরুদ্ধে আপিল করছেন।