কোপার্নিকাসের কবর আবিষ্কারের অদ্ভুত গল্প
জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস পাঁচ শতাব্দী আগেই বলেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। তিনি রেনেসাঁর মানুষ যিনি একাধারে ছিলেন গণিতবিদ, প্রকৌশলী, লেখক, অর্থনীতিবিদ এবং চিকিৎসক। ১৫৪৩ সালে পোল্যান্ডের ফ্রমবোর্কে মৃত্যুর পর তাকে একটি স্থানীয় গীর্জায় কবর দেওয়া হয়। কয়েক শতাব্দী পরে তাঁর এই কবরের খোঁজ কালের গর্বে হারিয়ে যায়।
কোপার্নিকাস কে ছিলেন?
নিকোলাস কোপার্নিকাসের (পোলিশ ভাষায় মিকোলাজ কোপের্নিক) জন্ম ১৪৭৩ সালে পোল্যান্ডের টোরানে। তিনি তাঁর চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন।
কোপার্নিকাসের পিতার মৃত্যুর পর তাঁর লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন তাঁর চাচা। তিনি শুরুতে লেখাপড়া করেছিলেন ক্রেকো বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৪৯১ সাল থেকে ১৪৯৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে) এবং পরবর্তীতে লেখাপড়া করেন বলোগনা, পাডুয়া এবং ফেরারার ইতালিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
চিকিৎসাশাস্ত্র, আইন, গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া শেষ করে কোপার্নিকাস ১৫০৩ সালে বাড়ি ফিরে আসেন। তিনি তারপর তাঁর প্রভাবশালী চাচা কনিষ্ঠ লুকাস ওয়াজেনরোদের হয়ে কাজ করা শুরু করেন। তাঁর চাচা তখন ছিলেন ওয়ার্মিয়ার 'প্রিন্স বিশপ'।
গণিত নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই সময়, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং সংগীতকে গণিতের শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
এই সময়টাতে তিনি অর্থনীতির দুটো গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব দিয়েছিলেন। ১৫১৭ সালে তিনি 'অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব' প্রবর্তন করেন যেটি পরবর্তীতে জন লক এবং ডেভিড হিউম পুনরায় বর্ণনা করেন। ১৯৬০ এর দশকে এই তত্ত্বকে বিখ্যাত করে তুলেন মিল্টন ফ্রিডম্যান। ১৫১৯ সালে তিনি আরেকটি তত্ত্ব দেন যেটি এখন গ্রিশামের তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। এই তত্ত্বে অর্থের প্রচলন এবং মূল্যায়ন নীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
মহাবিশ্বের কোপার্নিকাস মডেল
বিজ্ঞানের জগতে কোপার্নিকাস এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো এই মডেল। এর পূর্বে টলেমির মডেলে বলা হয়েছিলো পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থান করছে কিন্তু কোপার্নিকাসই প্রথম বলেন সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীসহ সৌরজগতের বাকি গ্রহগুলো ঘুরছে। সুর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের উপর ভিত্তি করে তিনি পরবর্তীতে গ্রহগুলোর কক্ষপথের আকৃতি নির্ণয় এবং সেগুলোর মধ্যে তুলনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কোপার্নিকাসের ভয় ছিল তাঁর কাজগুলো গির্জা এবং সহকর্মীরা স্বাভাবিকভাবে নিবেনা। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ "ডি রেভ্যুলোশনিবাস অরবিয়াস কোলেস্টিয়াম" (অন দা মুভমেন্ট অফ দা সেলেস্টিয়াল স্ফিয়ারস) তাঁর মৃত্যুর পর ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর এই প্রকাশনা মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া নিয়ে বড় পরিবর্তন আনে এবং এর উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিওর (যিনি কোপার্নিকাসের মৃত্যুরও ২০ বছর পরে জন্মেছিলেন) মত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে কাজ করার অনুপ্রেরণা পান।
কোপার্নিকাসের সন্ধানে
ফ্রমবোর্ক গির্জায় ১০০র মত ব্যক্তিকে সমাহিত করা হয়েছে যার মধ্যে অধিকাংশের কবরের ফলকে কোন নাম ছিল না।
১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীর দিকে অনেকবার কোপার্নিকাসের সমাধি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেও তা ব্যর্থ হয়েছিলো। আরেকটি ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন ফ্রেঞ্চ সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮০৭ সালের এলোউ যুদ্ধের পর। নেপোলিয়ন কোপার্নিকাসকে পলিম্যাথ, গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে উচ্চ সম্মান দিয়েছিলেন।
২০০৫ সালে একদল পোলিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ তাঁর কবরের খোঁজ করা শুরু করেন। তারা ইতিহাসবিদ জের্জি সিকোরস্কির তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই সন্ধান চালিয়েছেন যেখানে সিকোরস্কি দাবি করেছিলেন যে ফ্রমবোর্ক গির্জার দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত কোপার্নিকাসকে গির্জার বেদির কাছেই সমাহিত করার কথা। এটি ছিল সেন্ট ওয়াকলের বেদি যা এখন পবিত্র ক্রুশের বেদি নামে পরিচিত।
এই বেদির কাছে ১৩টির মত কঙ্কাল আবিষ্কার করা হয় যার মধ্যে একটি ছিল ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী এক পুরুষের অসম্পূর্ণ কঙ্কাল। এই বিশেষ কঙ্কালটির সাথেই কোপার্নিকাসের সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া গিয়েছিলো।
ফরেনসিক বিজ্ঞান
এই কঙ্কালের খুলি কোপার্নিকাসের মুখের পুনর্গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিলো।
রূপতাত্ত্বিক (মরফোলজিকাল) অধ্যয়ন ছাড়াও, ডিএনএ বিশ্লেষণ প্রায়শই ঐতিহাসিক বা প্রাচীন অবশেষ শনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। কঙ্কালটির দাঁত ভালোভাবে সংরক্ষিত থাকায় কোপার্নিকাসের অনুমিত দেহাবশেষের জেনেটিক শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছিল।
রেফারেন্স তৈরির ক্ষেত্রে একটি যথার্থ নমুনার খোঁজ করা বেশ কঠিন ছিল যেহেতু কোপার্নিকাসের কোন আত্মীয়ের দেহাবশেষের খোঁজ জানা ছিল।
একটি অসম্ভব আবিষ্কার
২০০৬ সালে ডিএনএ রেফারেন্সের জন্য একটি নতুন নমুনার খোঁজ পাওয়া যায়। কোপার্নিকাসের ব্যবহৃত একটি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বইয়ের ভেতর তাঁর চুলের খোঁজ পাওয়া যায়।
১৭ শতাব্দীর মাঝামাঝি সুইডেন যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করে তখন এই বইটি লুট করে সুইডেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি বর্তমানে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুস্তাভিয়ানাম যাদুঘরের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত আছে।
সূক্ষ্ম যাচাইয়ের পর বইটির থেকে কিছু চুল পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় চুলগুলো বইটির মালিক কোপার্নিকাসের নিজের। এই চুলগুলোকে সমাধি থেকে উদ্ধার করা দাঁত এবং হাড়ের পদার্থের সাথে জেনেটিক তুলনা করার জন্য সম্ভাব্য রেফারেন্স উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
আবিষ্কৃত কঙ্কালের দাঁত ও হাড়ের ডিএনএর সাথে চুলের তুলনা করা হয়েছিল। দাঁত থেকে প্রাপ্ত মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এবং কঙ্কালের নমুনা উভয়ই চুলের সাথে মিলে গিয়েছিলো। এর থেকে বোঝা গিয়েছিলো যে অবশিষ্টাংশগুলি প্রকৃতপক্ষে নিকোলাস কোপার্নিকাসের।
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, রূপতাত্ত্বিক (মরফোলজিকাল) অধ্যয়ন এবং উন্নত ডিএনএ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই কোপার্নিকাসের কবর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছিলো
ফ্রমবোর্ক গির্জার পবিত্র ক্রুশের বেদির কাছে আবিষ্কৃত দেহাবশেষটি নিকোলাস কোপার্নিকাসের। এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তির কবর খুঁজে বের করার পাশাপাশি ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে বের করার জন্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গভীরতা এবং সক্ষমতাকেও তুলে ধরে।