দিনের কোন সময়টি ব্যায়ামের জন্য বেশি উপযুক্ত?
আর কয়েক মাস পরেই বিশ্বের নামিদামি ক্রীড়াবিদরা অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করবেন সোনার মেডেলের আশায়। যারা তাদের অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী দিয়ে রেকর্ডের পাতায় নিজেদের নাম লিখতে চান তারা সকলেই মাঠে নামার আগে ঘড়ির কাঁটা দেখে নিজেদেরকে শেষবারের মত প্রস্তুত করবেন।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা এটাই বলে যে সাঁতারুরা ঘড়ির কাঁটা সব থেকে বেশি মেনে চলেন। সর্বশেষ এথেন্স (২০০৪), বেইজিং (২০০৮), লন্ডন (২০১২) এবং রিও (২০১৬) অলিম্পিকের আসরগুলোতে দেখা গেছে যে সাঁতারুরা সবচেয়ে দ্রুত সাঁতরাতে পারেন যদি তাদের প্রতিযোগিতাগুলো সন্ধ্যার আগেই আয়োজিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিকাল ৫ টা ১২ এর দিকে। এটি এই প্রমাণ করে যে দিনের সময়ের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে মানুষের কর্মক্ষমতাও পরিবর্তিত হয়।
শুধু নামিদামি অলিম্পিয়ানদের মধ্যেই বিষয়টি দেখা যায় এমনটা নয়। সখের সাইক্লিস্টরাও সবচেয়ে দ্রুত ট্রায়াল দিতে পারেন সন্ধ্যার সময়। শরীরচর্চার সাথে সময়ের বিশেষ সম্পর্ক আছে কারণ দেখা গেছে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে এইধরনের ব্যায়াম থেকে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। কোন সময়টা ব্যায়ামের জন্য সবচেয়ে ভালো সেটা নারী এবং পুরুষের ক্ষেত্রেও আলাদা।
আমাদের শরীর কীভাবে অনুশীলন করে এবং ব্যায়ামের প্রতি সাড়া দেয় তার পার্থক্যের মূলে রয়েছে আমাদের সার্কাডিয়ান ছন্দ (সার্কাডিয়ান রিদম) যেটি আমাদের শরীরের মলিকুলার ঘড়ি দ্বারা চালিত হয়। এই মলিকুলার ঘড়ি দিনের ২৪ ঘণ্টা সময় ধরে আমাদের নিয়মিত অভ্যাসগুলো যেমন ঘুম এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী।
আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে একটি কেন্দ্রস্থ ঘড়ি আছে যেটি অপটিক স্নায়ু থেকে সংকেতের মাধ্যমে আলোর প্রতি সাড়া দেয়। হাইপোথ্যালামাসের সার্কাডিয়ান পেস-মেকার যেটি সুপ্রাকিয়াজমেটিক নিউক্লিয়াস হিসাবে পরিচিত সেটি আমাদের দেহের অন্যান্য অঙ্গ, পেশি টিস্যু এবং চর্বি টিস্যুতে অবস্থিত পেরিফেরাল ঘড়িতে সংকেত পাঠায়। এই সংকেত আমাদের পুরো শরীরের সাথে মস্তিষ্কের ছন্দ তৈরি করে। এই পেরিফেরাল ঘড়ি বিভিন্ন কাজ যেমন খাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের দেহের সাথে মস্তিষ্কের ছন্দ তৈরি করে। আমাদের "স্কেলেটাল মাসল ঘড়ি" ব্যায়ামের জন্য এইভাবে সাড়া দেয় এবং এর জন্যই দিনের বিভিন্ন সময়ে নিয়মিত ব্যায়াম করে দেহের সাথে মস্তিষ্কের ছন্দ রক্ষা করা সম্ভব।
কিন্তু আমাদের কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি এটি আমাদের স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে।
সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইন্সটিটিউটের শরিরচর্চাবীদ জুলিন জিরেথ শরীরচর্চার সাথে 'সার্কাডিয়ান সিস্টেমের' সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা আবিষ্কার করেছেন যেসকল ইঁদুর দিনের বেলা ব্যায়াম করে সেগুলো বেশী মেদ ঝরাতে পারে। জিরেথের ভাষ্যমতে এই আবিষ্কার থেকে এটি অন্তত বোঝা যায় যে দিনের বিশেষ সময়ে ব্যায়াম করলে সেটি টাইপ ২ ডায়বেটিস এর মত বিপাকীয় (মেটাবলিক) রোগগুলোর প্রতিকারে ভালো কার্যকরী হবে।
জিরেথ বলেন, "সবাই এই ব্যাপারে একমত যে ব্যায়াম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিন্তু একজন ব্যক্তি দিনের কোন সময়ে ব্যায়াম করছে সেটি তাঁর বিপাকীয় (মেটাবলিক) ক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলে"।
তাদের গবেষণার ফলাফল মানুষের উপরে হওয়া আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণাকে প্রতিফলিত করে যেটিতে দেখা যায় শরীরচর্চা, 'ইন্টারভাল স্প্রিন্ট', স্ট্রেচিং এবং প্রতি সপ্তাহে যে কোন একদিন সকালে এক ঘণ্টার জন্য 'এন্ডুরেন্স' মহিলাদের পেটের চর্বি এবং রক্তচাপ কমাতে পারে। মজার বিষয় হল মহিলারা যখন সন্ধ্যায় একই ব্যায়াম করেন তখন এটি তাদের পেশির কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
পুরুষের ক্ষেত্রে সন্ধ্যার দিকের ব্যায়াম নিম্ন রক্তচাপ কমানোর পাশাপাশি শরীরের মেদ কমাতে সাহায্য করে।
কিন্তু এই বিষয়ে গবেষণা এখনো চলমান এবং সাম্প্রতিক কিছু বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে ব্যায়ামের কার্যকারিতা বা স্বাস্থ্যের উপর ব্যায়ামের প্রভাবের সাথে সময়ের যে সম্পর্ক তা এখনও অমিমাংসিত।
দিনের কোন সময়টি ব্যায়ামের জন্য ভালো সেটি নির্ভর করে আসলে মানুষ নিয়মিত কোন সময়টিতে ঘুম থেকে উঠে এবং ঘুমাতে যায় তার উপর। কোন কোন ব্যক্তি সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার কেউ দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। এই ঘুম থেকে উঠা এবং ঘুমাতে যাওয়ার উপর নির্ভর করে তাদের শরীরের উপর ব্যায়ামের কার্যকারিতা।
যুক্তরাষ্ট্রের গাইন্সভিলে অবস্থিত ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরচর্চাবীদ ক্যারিন ইজারের মতে, "আমাদের একজনের সাথে আরেকজনের সময়ের তারতম্য বিদ্যমান। আমাদের মধ্যে যারা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তাদের ঘড়ি সম্ভবত ২৪ ঘণ্টার থেকে একটু কম চলে এবং যারা রাত জাগে তাদের ঘড়ি সম্ভবত ২৪ ঘণ্টার থেকে একটু বেশী চলে"।
ইজারের নেতৃত্বে কয়েকজন গবেষক খুঁজে পেয়েছেন সকালে যেসকল ইঁদুর কঠোর ব্যায়াম করে সেইগুলো নতুন যেকোনো ধরনের ব্যায়ামের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। এই ধরনের ব্যায়ামের ফলে ইঁদুরগুলোর কঙ্কাল পেশি এবং ফুসফুসের টিস্যুতে অবস্থিত মলিকুলার ঘড়িতে পরিবর্তন আসে।
এই গবেষণাদলের বর্তমান গবেষণার ফলাফল (যেটি এখনও কোন স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ করা হয়নি) থেকে জানা যায় কর্মক্ষমতার দিকে থেকে সকালবেলায় প্রশিক্ষণ নেয়া ইঁদুরগুলো সন্ধ্যার সময় প্রশিক্ষণ নেয়া ইঁদুরগুলোর থেকে বেশী এগিয়ে। ছয় মাসের প্রশিক্ষণের পর সকাল এবং সন্ধ্যার ইঁদুরগুলো একইরকম কর্মক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, মানুষের মধ্যেও একইরকম প্রভাব থাকলে একজন ক্রীড়াবিদ সঠিক ব্যায়ামের মধ্য দিয়ে নিজের 'মাসল ক্লকের' সাথে মস্তিষ্কের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, নিয়মিত ব্যায়াম মানুষের সার্কাডিয়ান ছন্দের পরিবর্তন ঘটায় যেটি তাদেরকে কাজের সময়ের পরিবর্তন অথবা জেট ল্যাগের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।
ইজার বলেন, "এইখানে বিষয়টা এমন যে আমাদের পেশির ঘড়িগুলো আসলে আমরা কখন ব্যায়াম করি সেটার প্রতি খেয়াল রাখে"।
এইখানে অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কারণ একই ব্যায়াম প্রতিদিন একই সময়ে করা হলে আমাদের শরীর আরও ভালোভাবে অভ্যস্ত হতে পারে।
এই ব্যাপারে জিরেথ বলেন, "আপনি যদি একজন সাধারণ ব্যক্তি হয়ে থাকেন অথবা যদি একজন নামিদামি ক্রীড়াবিদ হন, আপনাকে প্রতিযোগিতার জন্য নির্দিষ্ট ব্যায়াম করতেই হবে। আপনি কোন সময়ে ব্যায়াম করছেন তার উপর নির্ভর করবে প্রতিযোগিতা আপনি ভালো করতে পারছেন কিনা"।
বেশিরভাগ গবেষকই উল্লেখ করেছেন, যেকোনো সময় ব্যায়াম করার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু আপনি যদি এমন একটি সময় খুঁজে পান যখন আপনি ব্যায়াম করতে বেশী স্বাছন্দ্যবোধ করেন এবং সেই সময়ে নিয়মিত শরীরচর্চা চালিয়ে যান, আপনি আপনার শরীরকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারবেন।