বোতলজাত পানিতে ধারণার চেয়েও ১০০ গুণ বেশি ন্যানোপ্লাস্টিক!
প্রচণ্ড তৃষ্ণায় আপনি দোকান থেকে একটি বোতলজাত পানি কিনে তৃষ্ণা মেটালেন। কিন্তু আপনি হয়তো জানেনই না যে, আপনার অজান্তেই এই পানির মাধ্যমে শরীরের ভেতরে চলে যাচ্ছে অদৃশ্য মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মানুষ প্রতি এক লিটার বোতলজাত পানি পান করার সময় হাজার হাজার মাইক্রোস্কোপিক প্লাস্টিকের টুকরো গিলে ফেলছে। যা তাদের স্বাস্থ্যের ওপর ফেলছে ক্ষতিকর প্রভাব।
আগে ধারণা করা হত, একজন ব্যক্তি গড়ে প্রতি সপ্তাহে একটি ক্রেডিট কার্ডের সমপরিমাণ মাইক্রোস্কোপিক প্লাস্টিক কণা কোনো না কোনো ভাবে গ্রহণ করেন। তবে নতুন গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে, এর পরিমাণ হবে আরও বেশি।
সাধারণত ৫ মিলিমিটার (০.২ ইঞ্চি) থেকে ছোট প্লাস্টিকই মাইক্রোপ্লাস্টিক। এগুলো শিল্প বর্জ্য এবং বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীতে পাওয়া যায়।
সময়ের সাথে সাথে এই মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো আরও ভেঙে তথাকথিত ন্যানোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। এই ন্যানোপ্লাস্টিকগুলো এতটাই ক্ষুদ্র যে, তা আমাদের অন্ত্র এবং ফুসফুসের মধ্য দিয়ে সরাসরি রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে রক্তের মাধ্যমে আমাদের আমাদের হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কের মত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পৌঁছে সেখানকার ক্ষতিসাধন করতে পারে।
প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এ গতকাল (সোমবার) প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, বোতলজাত পানিতে থাকা প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার কণা পাওয়া গেছে। যার বেশির ভাগই 'ন্যানোপ্লাস্টিক' অর্থাৎ এক মাইক্রোমিটারেরও কম (মানুষের চুলের প্রস্থের সত্তর ভাগের এক ভাগ)।
গত কয়েক বছরে বিজ্ঞানীরা তাদের অনুসন্ধানে এক মাইক্রোমিটার থেকে আধা সেন্টিমিটারের 'মাইক্রোপ্লাস্টিক' খুঁজে পেয়েছেন। সর্ব উত্তরের আর্কটিক অঞ্চল থেকে মানুষের প্লাসেন্টা টিস্যু; সর্বত্রই পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি।
ইউনেস্কোর ওশান লিটারেসি পোর্টালের হিসেব অনুযায়ী, সমুদ্রে প্রায় ৫০ থেকে ৭৫ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের টুকরো রয়েছে। এই প্লাস্টিকগুলোই পরে আমাদের খাদ্যচক্রে এসে যুক্ত হয়।
এরির পেন স্টেট বেহরেন্ডের সাসটেইনেবিলিটি বিভাগের অধ্যাপক ও পরিচালক শেরি ম্যাসন জানান, প্লাস্টিকের উপকরণগুলো অনেকটা চামড়ার মতো। এগুলো টুকরো টুকরো হয়ে পানি, খাবার বা যে কোনো পদার্থে পরিণত হয়।
কলম্বিয়ার রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ওয়েই মিন বলেন, "মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যা-ই করুক না কেন, আমি বলব ন্যানোপ্লাস্টিক আরও বিপজ্জনক হতে যাচ্ছে।"
মাইক্রোপ্লাস্টিক সন্ধানের পদ্ধতি কিছুটা জটিল। ওয়েই মিন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যার মাধ্যমে একটি নমুনায় দুটি লেজার ছোঁড়া হয় এবং বিভিন্ন অণুর অনুরণন পর্যবেক্ষণ করা হয়। মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে দলটি এভাবে তিন ধরনের বোতলজাত পানির নমুনায় সাত ধরনের প্লাস্টিকের অণু সনাক্ত করতে সক্ষম হন।
কলাম্বিয়ার রসায়ন বিভাগের পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং এই গবেষণাপত্রের প্রথম লেখক নাইক্সিন কিয়ান বলেন, "ন্যানোপ্লাস্টিক শনাক্তের আরও কিছু কৌশল রয়েছে। কিন্তু আমাদের গবেষণার আগে সেসবের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না।"
অধ্যাপক ম্যাসন বলেন, "সাধারণ মানুষ পানির নমুনার দিকে তাকিয়ে যদি দৃশ্যমান প্লাস্টিক দেখে, তাহলে সেগুলো খাওয়া বন্ধ করে দেবে। কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারে না যে আসলে উপস্থিত অদৃশ্য প্লাস্টিকই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।"
নতুন এ গবেষণায় পিইটি (পলিথিলিন টেরেফথ্যালেট) এর টুকরো পাওয়া গেছে, যা দিয়ে বেশিরভাগ প্লাস্টিকের পানির বোতল তৈরি হয়। এছাড়া পানির ফিল্টারে পাওয়া গেছে পলিমাইডের উপস্থিতি। গবেষকদের ধারণা, এর অর্থ প্লাস্টিক, বোতল এবং পরিস্রাবণ প্রক্রিয়া উভয় থেকেই পানিতে প্রবেশ করছে।
গবেষণার নমুনায় পাওয়া প্লাস্টিকের কণাগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল ন্যানোপ্লাস্টিকস এবং মাত্র ১০ শতাংশ ছিল মাইক্রোপ্লাস্টিক। যা পূর্ববর্তী ধারণার চেয়ে ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। এই ন্যানোপ্লাস্টিক যথেষ্ট ছোট; যা কোনও ব্যক্তির রক্ত, লিভার এবং মস্তিষ্কে সহজে প্রবেশ করতে পারে।
তবে ন্যানো ও মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক কতটা বিপজ্জনক তা গবেষকরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি পর্যালোচনায় বলেছে যে, পানির মাধ্যমে প্রবেশ করা মাইক্রোপ্লাস্টিকের মানব স্বাস্থ্যে প্রভাব রাখার এখনও দৃঢ় কোনো প্রমাণ নেই। তাই এর জন্য আরও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।