আমাজনে হারিয়ে যাওয়া বিশাল নগরীর সন্ধান
আমাজনে বিশাল প্রাচীন নগরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যা হাজার বছর ধরে সবুজ গাছপালায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
এই আবিষ্কারটি আমাজনে বসবাসকারী মানুষ সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণা পরিবর্তন করে দিয়েছে। পূর্ব ইকুয়েডরের উপানো এলাকার বাড়িগুলো এবং প্লাজাগুলো রাস্তাঘাট এবং খালের বিস্ময়কর নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত ছিল।
এলাকাটি একটি আগ্নেয়গিরির ছায়ায় অবস্থিত যা উক্ত এলাকার মাটি উর্বর করেছিলো। কিন্তু এই আগ্নেয়গিরির কারণেই সম্ভবত নগরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।
দক্ষিণ আমেরিকার উঁচু শহরগুলো যেমন পেরুর মাচু পিচু সম্পর্কে মানুষের জানা থাকলেও ধারণা করা হতো যে, আমাজনে মানুষ শুধু যাযাবর হিসেবে বা ছোট বসতিতে বসবাস করতো।
ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের তদন্ত পরিচালক অধ্যাপক স্টিফেন রোস্টেন যিনি এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেন, "এ শহরটি আমাদের চেনা আমাজনের অন্যান্য জায়গা থেকে পুরোনো। সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে ইউরোপকেন্দ্রিক এক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু এটি আমাদের দেখায় যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিবর্তন করতে হবে।
গবেষনাদলের সহকারী লেখক অ্যান্টোইন ডরিসন বলেন, "এটি আমাদের আমাজনীয় সংস্কৃতিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করেচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ আমাজনের মানুষ বলতেই ছোট দলকে ভেবে নেয় যারা সম্ভবত নগ্ন, কুঁড়েঘরে বসবাস করে এবং জমিজমা পরিষ্কার করে। এই আবিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছে প্রাচীন মানুষেরা জটিল শহুরে সমাজে বাস করত।"
শহরটি প্রায় ২৫০০ বছর আগে নির্মিত হয়েছিলো এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ১ হাজার বছর পর্যন্ত মানুষ সেখানে বসবাস করতো।
এক সময়ে কত লোক সেখানে বাস করত তা সঠিকভাবে অনুমান করা কঠিন। তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে ১ লাখ না হলেও ১০ হাজারের মত লোক সেখানে বসবাস করতো।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা লেজার সেন্সর ব্যবহার করে ৩০০ বর্গ কিমি (১১৬ বর্গ মাইল) এলাকায় খনন চালিয়েছেন ঘন জঙ্গল এবং গাছপালার নিচে শহরের অবশিষ্টাংশ শনাক্ত করার জন্য।
এই এলআইডিএআর প্রযুক্তিটি প্রায় ২০ মিটার (৬৬ ফুট) দৈর্ঘ্য, ১০ মিটার (৩৩ ফুট) প্রস্থ এবং ২-৩ মিটার উঁচু ৬ হাজার আয়তাকার প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেয়েছে। প্লাটফর্মগুলো একটি কেন্দ্রীয় প্লাটফর্ম সহ একটি প্লাজার চারপাশে তিন থেকে ছয় ইউনিটের দলে সাজানো ছিল।
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, এগুলির মধ্যে অনেকগুলোই বাড়ি ছিল। তবে কিছু বাড়ি আচারানুষ্ঠানের উদ্দেশ্যেও তৈরি করা হয়েছিল।
কিলামোপেতে একটি কমপ্লেক্স ১৪০ মিটার (৪৫৯ ফুট) দৈর্ঘ্য ও ৪০ মিটার (১৩১ ফুট) প্রস্থের প্ল্যাটফর্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এগুলো পাহাড় কেটে এবং উপরে মাটির প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো।
সোজা রাস্তা এবং পথের একটি নেটওয়ার্ক অনেকগুলি প্ল্যাটফর্মকে একত্রে সংযুক্ত করেছে যার মধ্যে একটি ২৫ কিলোমিটার (১৬ মাইল) পর্যন্ত প্রসারিত।
ড. ডরিসন বলেছেন, এই রাস্তাগুলো গবেষণার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ।
তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, "রাস্তার নেটওয়ার্ক খুবই বাস্তবধর্মী। এটি অনেক জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এবং সবকিছুই সংযুক্ত। রাস্তাগুলো মাপে ঠিক ছিল যেটি আসলেই চমৎকার।"
তিনি বিশ্বাস করেন যে, এর মধ্যে কয়েকটি নেটওয়ার্ক "খুব শক্তিশালী অর্থ" বহন করে যা কোনো বিশ্বাসের সাথে যুক্ত।
বিজ্ঞানীরা দুপাশে খাল সহ কিছু পথ চিহ্নিত করেছেন যা এই অঞ্চলে প্রচুর পানি সরবরাহ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিছু খাদ বসতিগুলোর প্রবেশপথকে অবরুদ্ধ করেছিলো যা শহরগুলো এবং আশেপাশের লোকদের জন্য ক্ষতিকর ছিল।
গবেষকেরা প্রথম এই অঞ্চলে ১৯৭০ এর দশকে একটি শহরের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছিলেন কিন্তু ২৫ বছর গবেষণার পর এই প্রথম একটি বিস্তারিত জরিপ করা সম্ভব হয়েছে।
এর মাধ্যমে একটি বড় সভ্যতার সন্ধান পাওয়া গেলো যা মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার সুপরিচিত মায়ান সভ্যতার থেকেও বড় বলে মনে করা হচ্ছে।
এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক জসে ইরিয়ার্ত যিনি এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন না বলেন, "কল্পনা করুন যে আপনি মায়ানের মতো একটি সভ্যতা আবিষ্কার করেছেন যেটির স্থাপত্য, ভূমির ব্যবহার এবং সিরামিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন।"
একত্রে সাজানো অষ্টাভুজাকার এবং আয়তক্ষেত্রাকার প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতি নির্দেশ করে তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই ধরনের কিছু আবিষ্কার দক্ষিণ আমেরিকার জন্য 'অনন্য'।
তিনি আরো বলেন, পূর্বের এই সভ্যতাগুলো পরিষ্কারভাবে সুসংগঠিত এবং সংযুক্ত ছিল যা বসতিগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া রাস্তাকে চিহ্নিত করে।
সেখানে বসবাসকারী মানুষ এবং তাদের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে খুব বেশি পরিমাণে তথ্য এখনো জানা যায়নি।
প্ল্যাটফর্মগুলোতে গর্ত এবং চুলার পাশাপাশি বয়াম, গাছপালা এবং পোড়া বীজ পেষার জন্য পাথর পাওয়া গেছে। সেখানে বসবাসরত কিলামপে এবং উপানো লোকেরা সম্ভবত বেশিরভাগই কৃষি কাজ করতো। লোকেরা ভুট্টা ও মিষ্টি আলু খেতো এবং সম্ভবত "চিচা" (এক ধরনের মিষ্টি বিয়ার) পান করত।
অধ্যাপক রোস্টেইন বলেছেন যে, তাকে তার কর্মজীবনের শুরুতে এই গবেষণার বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছিল কারণ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেছিলেন যে আমাজনে কোন প্রাচীন গোষ্ঠী বাস করতোনা।
তিনি বলেছেন, "কিন্তু আমি খুব জেদী, তাই যেভাবেই হোক আমি এটা করেছি। এখন আমি স্বীকার করব যে এত বড় আবিষ্কার করতে পেরে আমি খুব খুশি।"
গবেষকদের জন্য পরবর্তী ধাপ হলো আশেপাশের ৩০০ বর্গ কিলোমিটারের এলাকা যেখানে এখন জরীপ চালানো হয়নি এবং খুঁজে বের করা সেখানে কি আছে।