৬৫ মিলিয়ন বছরের পুরোনো আমাজন বন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে: গবেষণা
২০৫০ সালের মধ্যে আমাজন রেইনফরেস্টের ক্ষয়ক্ষতি এমন এক চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছাবে যেখান থেকে এর পুনরুদ্ধার একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়বে। যার ভয়ানক প্রভাব পড়বে এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে।
গত বুধবার প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্য ফুটে উঠেছে। একইসাথে জলবায়ু পরিবর্তন সামাল দেয়ার সক্ষমতাও হারাবে পৃথিবী।
গত ৬৫ মিলিয়ন বছর ধরে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে আছে আমাজন। কিন্তু বনাঞ্চল ধ্বংস এবং মানব সৃষ্ট জলবায়ু সংকট বনের পরিবেশের উপর নতুন মাত্রার চাপ যোগ করেছে। যার ফলে আগামী তিন দশকের মধ্যে রেইনফরেস্টটির বাস্তুতন্ত্রে বিশাল আকারের ধস নামার সম্ভাবনা রয়েছে।
গবেষকগণ ধারণা করছেন, আমাজনের ১০ থেকে ৪৭ শতাংশ অংশ নতুন এই চাপের সম্মুখীন হবে; যা বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাপক মাত্রার প্রভাব ফেলবে। এমতাবস্থায় নির্দিষ্ট একটি মাত্রা অতিক্রম করলেই রেইনফরেস্টটিকে রক্ষা পুরোপুরি অসম্ভব হয়ে পড়বে।
'নেচার' জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে ব্রাজিলের ফেডেরাল ইউনিভার্সিটি অব সান্তা ক্যাটারিনা। গবেষণাটি আমাজন রেইনফরেস্ট কতটা দ্রুত ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে সে ব্যাপারে সামগ্রিক আলোচনা করেছে। গবেষকগণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ভয়ানক খরা, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং দাবানলের প্রভাব নিয়ে কাজ করে এই ফলাফলে পৌঁছেছে।
সিএনএন-এর কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক বার্নার্ডো ফ্লোরেস বলেন, "রেইনফরেস্ট ধ্বংসের পেছনের কারণগুলো আমাদের আগে থেকে জানা থাকলেও জটিল এই ধাঁধার প্রতিটি টুকরো একত্র করার পর উদ্বেগজনক এই চিত্রটি আরো পরিষ্কার হয়ে যায়।"
ধারণার অনেক আগেই ধস নামবে আমাজন রেইনফরেস্টের অনন্য এই বাস্তুতন্ত্রে। রেইনফরেস্টের এমন অবস্থা পূর্বে ধারণা করা হলেও তা একুশ শতকেই এই মাত্রায় পৌঁছে যাবে তা ধারণা করেনি গবেষকরা।
কার্বন দূষণের কারণে গ্রহের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এমতাবস্থায় পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্তৃত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় 'রেইনফরেস্ট' আমাজন পরিবেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কার্বন দূষণ শোষণ করে। ফলে এর কোন ধরনের ক্ষতি বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব রাখবে।
একসময় পৃথিবীর 'ফুসফুস' হিসেবে পরিচিত আমাজন এখন কার্বন শোষণ থেকে নির্গমন করে থাকে বেশি মাত্রায়। দাবানল এবং বনায়ন ধ্বংস এর মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়।
তবে আমাজন এখনও বিশাল বিস্তৃত বনাঞ্চল; যা মূল কার্বন দূষণ প্রশমিত করার ক্ষমতা রাখে। আমাজন রেইনফরেস্ট সমগ্র পৃথিবীর প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছরের সমপরিমাণ কার্বন ধারণ করে থাকে।
বিলুপ্তির পথে 'ফ্লাইং রিভারস'
আমাজন বনের অবনতি দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য অংশের বনাঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই ধারণা করা হয়েছে গবেষণায়। বনটি এই সমগ্র অঞ্চল জুড়ে পানি সরবরাহ হয়ে থাকে।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের অধিকাংশ বৃষ্টিপাতের মূল ভূমিকায় রয়েছে আমাজনের 'ফ্লাইং রিভারস'। আমাজনের উপরে বাষ্পীভূত পানি, মেঘের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে। এই বৃষ্টির পানির উপরই নির্ভর করে অন্যান্য অঞ্চলের বনভূমি এবং তাদের বাস্তুসংস্থান।
ব্রাজিল, বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে জুড়ে অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ উষ্ণমণ্ডলীয় জলাভূমি পানটানাল ও লা প্লাটা রিভার বেসিনের জীববৈচিত্র্য এবং প্রধান পানি ব্যবস্থাপনা পুরোটাই নির্ভর করে এই রেইনফরেস্টের উপর। যা দক্ষিণ আমেরিকার এক-পঞ্চমাংশ ভূমি থেকে পানি নিষ্কাশনে সাহায্য করে।
ফ্লোরেস জানান, "আমাজন ফরেস্ট পরিবেশের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে আর্দ্রতা সঞ্চালন প্রক্রিয়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে বিস্তৃত এই রেইনফরেস্ট। বনাঞ্চল হ্রাস পেলে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ভারসাম্য রক্ষায় বৈশ্বিক জলবায়ু নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করে।"
গবেষকদের মতে আমাজনের বাস্তুতন্ত্রের ধসের মাঝে পানির অভাব দেখা দিয়েছিল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন পানির এই অভাবকে আর তীব্র করে তুলেছে। ফলে আমাজনের পরিবেশ আরো শুষ্ক এবং উষ্ণ হয়ে উঠছে।
পানির এই বাড়তি অভাব উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কম খরা প্রতিরোধী গাছগুলোতে বেশি প্রভাব ফেলছে। এই অবস্থা আরো বাড়তে থাকলে এই অঞ্চলের গাছগুলো বিপন্ন হতে শুরু করবে বলে মনে করছে গবেষকরা। মাত্রাতিরিক্ত গরম এবং স্থানীয় আদিবাসীদের জন্য সম্পদ কমে যাওয়ায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে আমাজন।
ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের ক্লাইমেট সায়েন্সের অধ্যাপক রিচার্ড অ্যালান বলেন, "মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন এবং বনভূমি নিধন আমাজন রেইনফরেস্টের ক্ষতির মূল কারণ। পৃথিবীর এই অপূরণীয় সম্পদ আজ দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসের মুখে।"
গবেষণাপত্রটিতে বনভূমি উজার বন্ধ করতে, বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার করে সংরক্ষিত এলাকা এবং আদিবাসী ভূমি আরো বিস্তৃত করার কথা সুপারিশ করা হয়েছে। গ্রিণহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে বৈশ্বিক সহায়তা প্রয়োজন বলে জোর দিয়েছেন ফ্লোরেস। আমাজন রেইনফরেস্টের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল দেশগুলোকেও এই বনের পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
অনুবাদ: জেনিফার এহসান