অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় হিন্দু মন্দির, উদ্বোধন করলেন নরেন্দ্র মোদি
অযোধ্যা শহরে জনপ্রিয় হিন্দু দেবতা রামের একটি বিশাল মন্দির উদ্বোধন করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
১৯৯২ সালে হিন্দু জনতাদের ধ্বংস করে দেওয়া ১৬ শতকের একটি মসজিদের জায়গায় এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। ওই মসজিদ ধ্বংসের ফলে দেশব্যাপী দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। সেই দাঙ্গায় প্রাণ হারায় প্রায় ২ হাজার মানুষ।
চলচ্চিত্র তারকা, শিল্পপতি, ক্রিকেটারসহ কয়েক হাজার আমন্ত্রিত অতিথি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
তবে কিছু হিন্দু সাধক এবং বেশিরভাগ বিরোধী এ মন্দিরের উদ্বোধনের বিরোধিতা করে বলছেন, মোদি রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য এটি ব্যবহার করছেন।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। মোদির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলছেন, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এমন একটি দেশে এই মন্দিরের নামে ভোট চাইবে যেখানে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু।
এ মন্দির উদ্বোধনের মাধ্যমে অযোধ্যায় ভগবান রামের মন্দির নির্মাণের কয়েক দশকের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে বিজেপি।
অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন, অযোধ্যা হলো রামের জন্মস্থান এবং বাবরি মসজিদ এ দেবতার ঠিক জন্মস্থানে একটি রাম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর মুসলিম আক্রমণকারীরা তৈরি করেছিল। একই স্থানে একটি মন্দির নির্মাণের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বিজেপি ১৯৯০-এর দশকে রাজনৈতিকভাবে ভারতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ভূমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই চলেছে। অবশেষে ২০১৯ সালে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কিত ওই জমির মালিকানা হিন্দুদের দেন। আর মুসলিমদেরকে শহরের বাইরে একটি জমি দেওয়া হয় মসজিদ নির্মাণের জন্য।
২১৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত নতুন তিনতলা মন্দিরটি গোলাপি বেলেপাথর এবং কালো গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি। এটি ৭০ একর কমপ্লেক্সের ৭.২ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত।
মোদি মন্দিরের শুধু নিচতলা উদ্বোধন করবেন। বাকি অংশগুলো নির্মাণের কাজ বছরের শেষ নাগাদ সমাপ্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মন্দিরের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত দেবতার একটি ৫১ ইঞ্চি (৪.২৫ ফুট) মূর্তি গত সপ্তাহে উন্মোচন করা হয়েছিল। মন্দিরের মূল বেদিতে মূর্তিটি একটি মার্বেলের পিঁড়িতে স্থাপন করা হয়েছে।
সোমবার সকালে অযোধ্যার রাস্তায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও যানজট নিয়ন্ত্রণে হাজার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিজেপির জাফরান রঙের পতাকা এবং হিন্দু দেবদেবীর ছবি দিয়ে (যার অনেকগুলো উজ্জ্বল হলুদ এবং কমলা গাঁদা ফুলে সজ্জিত) প্রধান সড়কগুলো ছেয়ে গেছে।
সোমবারের অনুষ্ঠান যা মধ্যাহ্নের ঠিক পরে হওয়ার কথা, এর নাম দেওয়া হয়েছে 'প্রাণ প্রতিষ্ঠা' যা সংস্কৃত ভাষা থেকে "জীবনশক্তির প্রতিষ্ঠা" হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে যে আগুনের চারপাশে মন্ত্র উচ্চারণ এবং আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মূর্তি বা দেবতার ছবি পবিত্র জীবন ধারণ করে।
মোদির নেতৃত্বে অনুষ্ঠানটিতে ভারত ও বিদেশ থেকে হাজার হাজার আমন্ত্রিত অতিথি উপস্থিত থাকবেন। যার মধ্যে বলিউডের অমিতাভ বচ্চনসহ দক্ষিণী চলচ্চিত্রের তারকারা এবং সচিন টেন্ডুলকারসহ ক্রিকেটের বেশ কয়েকজন বড় তারকা ছিলেন।
ছোট শহরটিতে বড় জনসমাগম এড়াতে মোদি তীর্থযাত্রীদের অযোধ্যায় বেশি সংখ্যায় না এসে টেলিভিশনে অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখার জন্য আহ্বান করেছেন। এর জন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর স্কুল এবং কলেজগুলি বন্ধ ঘোষণা করার পাশাপাশি এবং পূর্ণ বা অর্ধ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষকে অনুষ্ঠান দেখতে উৎসাহিত করার জন্য শেয়ার বাজারও বন্ধ থাকবে।
মোদি মানুষকে প্রদীপ জ্বালাতে বলেছেন এবং বিজেপির সমর্থকরা দিল্লির বেশ কয়েকটি এলাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় বাড়ির ছাদে রামের ছবিসহ জাফরান রঙের পতাকা টাঙিয়েছে।
মন্দিরটিকে বড় অর্জন বলে অভিহিত করে মোদি বলেছেন, 'পুরো দেশ ২২ জানুয়ারির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।'
তিনি এই মাসের শুরুতে একটি বার্তায় বলেছিলেন, 'অনেকগুলো প্রজন্ম এই মুহূর্তটির জন্য উন্মুখ ছিল। তিনি আরও বলেন, পবিত্রকরণ অনুষ্ঠানে তিনি 'ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন'।
কিন্তু কিছু শীর্ষ ধর্মীয় সাধকের ভাষ্যমতে মন্দিরটি যেহেতু এখনও সম্পূর্ণ হয়নি তাই সেখানে এই আচারগুলো পালন করা হিন্দুধর্মের পরিপন্থি। এজন্যই অনেক বিরোধী নেতা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিছু বিরোধীশাসিত রাজ্যও এই দিনের জন্য তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, তিনি কলকাতায় দেবী কালীর মন্দিরে প্রার্থনা করবেন এবং তারপর একটি সর্ববিশ্বাসের সমাবেশে নেতৃত্ব দেবেন। পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য উড়িষ্যা হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র স্থান পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তীর্থযাত্রীদের আনার বড় পরিকল্পনা করেছে।
অযোধ্যার মন্দির কর্তৃপক্ষ আশা করছে, মন্দির সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে গেলে প্রতিদিন দেড় লাখের বেশি দর্শনার্থীর সমাগম ঘটবে।
এই প্রত্যাশিত ভিড় সামলানোর জন্য শহরটি কয়েক মাস ধরে অনেকগুলো নির্মাণকাজের জায়গা হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে একটি নতুন বিমানবন্দর এবং একটি রেলওয়ে স্টেশন খোলা হয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি নতুন হোটেল তৈরি করা হয়েছে এবং আগেরগুলোকে আরও উন্নত করা হয়েছে।
গঙ্গার উপনদী সর্যু নদীর তীরে অবস্থিত অযোধ্যার এই রূপান্তরের জন্য সরকার ৩৮৫ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে৷
কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা একটি 'বিশ্বমানের শহর নির্মাণ করছে যেখানে মানুষ তীর্থযাত্রী এবং পর্যটক হিসাবে আসে।'
তবে অনেক স্থানীয় মানুষ বিবিসিকে জানিয়েছে, রাস্তা প্রসারিত করতে এবং অন্যান্য স্থাপনা গড়তে তাদের বাড়ি, দোকান এবং 'ধর্মীয় প্রকৃতির কাঠামো' সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে।