সেনা নিহতের ঘটনায় ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের অঙ্গীকার, কতদূর এগোবেন বাইডেন?
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে সংঘাত দানা বাঁধছিল– তারই পরিণতিতে গতকাল রোববার জর্ডানের সিরিয়া সীমান্তের কাছে একটি ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে তিন মার্কিন সেনা। আহত আরও দুই ডজন। এই হামলার ঘটনায় ইরানের প্রক্সিদের দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন।
গাজা যুদ্ধ শুরুর পরে গত তিন মাস ধরেই ইরাক ও সিরিয়ায় অবস্থিত মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা করা হচ্ছিল। এতদিন তাতে কেউ নিহত নাহলেও আহত হয় কিছু সেনা। ওয়াশিংটনের অভিযোগ এগুলোর দায় ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর। যদিও, ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার গণহত্যার ঘটনায় শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে বেশিরভাগ আরব জনতাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুদ্ধ।
এই অবস্থায়, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনা ঘটবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হবে এমন আশঙ্কা বাইডেন ও তাঁর প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তাদেরও ছিল। সেনা নিহতের ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই এখন বাইডেন এমন পদক্ষেপ নেওয়ার চাপের মুখে রয়েছেন।
বাইডেনকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পাল্টা হামলার বিষয়ে তিনি কতদূর এগোবেন, এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি নেবেন কিনা। কারণ, গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর থেকে তাঁর প্রশাসন দাবি করেছে, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর সংঘাত ঠেকানোর চেষ্টা করছে।
মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে এপর্যন্ত ১৫০ বারের বেশি ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা হামলা করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ঘাঁটিগুলোর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিহত করে। এরপরেও যেসব ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে আঘাত করেছে, সেগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল মার্কিন সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র, অনাবাসিক ভবন বা অবকাঠামো। ফলে শুরুর দিকে বাইডেনও তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি এসব ঘটনা।
অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে হামলার তীব্রতা বাড়তে থাকলে বাইডেন প্রশাসন নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। বিশেষত, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে হুমকি হয়ে ওঠায় হুথিদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনে বিমান হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
তবে শত্রুর আক্রমণে মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনায় ভিন্ন ধরনের (আরও কঠোর) পদক্ষেপ দরকার বলে জানান মার্কিন কর্মকর্তারা। এবিষয়ে বাইডেনের উপদেষ্টারাও একমত, এবং রোববার এক ভিডিও কনফারেন্সে তাঁরা সেকথা প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো– বাইডেন কি সরাসরি ইরানে হামলা করার সিদ্ধান্ত নেবেন? বিরোধী রিপাবলিকানরা এরমধ্যেই সে দাবি তুলেছে। রিপাবলিকান এক আইনপ্রণেতার মন্তব্য– এমনটা না করলে তিনি (বাইডেন) নিজেকে 'কাপুরুষ' প্রমাণিত করবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃহত্তর যুদ্ধ হবে, নাকি শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তা ঠেকানো যাবে– যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত কোনদিকে মোড় নিবে।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রশাসনে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে কাজ করা এবং মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো ব্রায়ান কাটোলিস। তিনি বলেন, "মূল প্রশ্ন হলো– বাইডেন অঞ্চলটিতে সংঘটিত ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়া জানাবেন, নাকি আরও বড় ধরনের বার্তা দেবেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের পরাক্রম সম্পর্কে শত্রুদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করবে– যা দীর্ঘ কয়েক মাস ধরেই আর তাদের মধ্যে নেই।"
একথার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বাইডেন চাইলে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে তীব্র হামলা চালিয়ে পাল্টা জবাব দিতে পারেন, আবার ইরানে হামলার মাধ্যমে আরও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
কাটোলিস বলেন, "আমি নিশ্চিত তাঁরা (বাইডেন প্রশাসন) এ দুয়ের মাঝামাঝি কোনো পন্থা খুঁজছেন। অর্থাৎ, এত কঠোর পদক্ষেপও নয়– যা সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করবে, আবার খুব দূর্বল পদক্ষেপও নয়– যা (পাল্টাপাল্টি) সংঘাতকে জিইয়ে রাখবে। এই বিবেচনায়, যে ধরনের আঘাতকে সঠিক বলে মনে করবেন নীতি-নির্ধারকরা– সেটিই করা হবে।"
তিনি আরও বলেন, সেনা নিহতের ঘটনায় বাইডেন প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন, যদিও তিনি কী ভাবছেন– সে সম্পর্কে কোনো আভাস দেননি।
তাৎক্ষনিক এক বিবৃতিতে বাইডেন বলেন, "আমরা নিহত বীর সেনা সদস্যদের মর্যাদা রক্ষা করব। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা যে লড়াই করেছেন– তা অব্যাহত রাখব। যারা তাঁদের হত্যার জন্য দায়ী, নিঃসন্দেহে তাঁদের সকলকে আমাদের নির্ধারিত সময়ে এবং পছন্দমতো কায়দায় জবাবদিহির আওতায় আনব।"
এদিকে জর্ডানে যে ধরনের হামলা গতকাল করা হয়েছে, তা নতুন কিছু নয়। গত তিন মাস ধরেই ইরাক ও সিরিয়ায় মোতায়েন থাকা মার্কিন সেনারা এর সম্মুখীন হচ্ছে। তবে পার্থক্য, এটাই গতকালকের হামলাটি আগেরগুলোর চেয়ে বেশি সফল হয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন খতিয়ে দেখছে– বৃহত্তর যুদ্ধ বাধাতে ইরান ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছে, নাকি প্রক্সিদের মাধ্যমে মামুলি ধরনের হামলার পরিকল্পনা থাকলেও– এইক্ষেত্রে ভাগ্যক্রমে তারা মার্কিন সেনাদের হত্যা করতে পেরেছে।
গত কয়েক মাস ধরেন মার্কিন কর্মকর্তা বলে এসেছেন, তাঁরা মনে করেন, ইরান আমেরিকার সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। রোববারের ঘটনা তাঁদের দীর্ঘদিনের এই পর্যবেক্ষণকে বদলায়নি। তবে একইসঙ্গে তাঁরা এটাও বলছেন, ইসরায়েল যখন গাজায় হামলা করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ইরান তার প্রক্সি বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করছে।
সংবেদনশীল তথ্য হওয়ায়– নাম না প্রকাশের শর্তে, জ্যেষ্ঠ একজন মার্কিন কর্মকর্তা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, জর্ডানে ওই হামলা করে ইরান বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু করতে চায়নি।
তবে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষকরা এই হামলার বিষয়ে বিদ্যমান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করছেন। যার ভিত্তিতে জানা যাবে, তীব্র এই আক্রমণের নির্দেশ সরাসরি ইরান দিয়েছিল, নাকি প্রক্সি গোষ্ঠীটি নিজেরাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাঁর আগে এবিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে চাননি তিনি।
তবে এটাও ঠিক– নির্বাচনী বছরে ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এরমধ্যে সেনা নিহতের ঘটনায় রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা বাইডেনকে দায়ী করে বিবৃতি দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, গত তিন মাস ধরে তিনি কোনো চূড়ান্ত পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে ইরান এই সাহস পেয়েছে।
সাউথ ক্যারোলিনা রাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইরানের আচরণ বদলাতে প্রেসিডেন্ট কী পদক্ষেপ নেন– সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে পুরো বিশ্ব। এখনই ইরানে আঘাত করুন। তাঁদের ওপর কঠিন আঘাত করুন।"