মার্কিন ড্রোন হামলা: টাওয়ার ২২ কী, মার্কিন সেনারা কেন জর্ডানে?
ইরান সমর্থিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী বলেছে, জর্ডানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি 'টাওয়ার ২২' এ ড্রোন হামলায় তারা দায়ী। এ হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত ও অন্তত ৩৪ জন আহত হয়েছে।
এ হামলার জন্য হোয়াইট হাউস ইরানকে দোষারোপ করছে এবং 'অত্যন্ত ফলপ্রসূ জবাব' দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে ইরান এই অভিযোগ 'ভিত্তিহীন' উল্লেখ করে বলেছে, 'বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইরানের সংশ্লিষ্টতা নেই।'
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম ওই অঞ্চলে শত্রুর গুলিতে কোনো মার্কিন সেনা নিহত হলো। আর এ কারণে ওই অঞ্চলে এখন উত্তেজনা বাড়ছে এবং মার্কিন কর্মকর্তারা আসন্ন বড় কোনো সংঘাত এড়াতে কাজ করছেন।
টাওয়ার ২২ সামরিক ঘাঁটি যেখানে অবস্থিত
সিরিয়া সীমান্তের কাছে জর্ডানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় 'টাওয়ার ২২' নামের মার্কিন এই সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত।
হামলার বিষয়ে একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, 'শত্রুপক্ষের ড্রোনটি খুব নিচু ও খুব ধীর গতিতে আসছিল। একই সময়ে একটি আমেরিকান ড্রোনও একটি মিশন থেকে ঘাঁটিতে ফিরে আসছিল।'
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, মার্কিন ড্রোনটি যাতে গুলি করে ভূপাতিত না করা হয় সেজন্য ঘাঁটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া বৈশিষ্ট্যগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ টাওয়ার ২২-এ অবস্থানরত সৈন্যদের জন্য কোনো সতর্কতা ছিল না এবং ড্রোনটি যখন আঘাত হানে তখনও অনেকে তাদের কোয়ার্টারে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল।
মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) জানিয়েছে, ওই ঘাঁটিতে প্রায় ৩৫০ জন মার্কিন সেনা অবস্থান করছে, যারা ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত করতে জোটের সাথে এক হয়ে কাজ করছে।
সেন্টকম আরও জানায়, আহতদের মধ্যে আট সৈন্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জর্ডান থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের অবস্থা এখন স্থিতিশীল।
মধ্যপ্রাচ্যে কেন মার্কিন ঘাঁটি?
ইরাক, জর্ডান ও সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের নিয়ন্ত্রণে এক ডজনেরও বেশি ঘাঁটি রয়েছে। এগুলোর একটি 'টাওয়ার ২২'।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এসব ঘাঁটিতে ইরান কর্তৃক প্রশিক্ষিত, অর্থায়ন ও সজ্জিত গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছে।
ইসলামিক স্টেট গ্রুপ বা আইএসের পুনরুত্থান ঠেকাতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসেবে ও ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে দেশটিতে আড়াই হাজার মার্কিন সৈন্য অবস্থান করছে। সেই সঙ্গে জর্ডানে প্রায় তিন হাজার এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে সমর্থন দিতে সিরিয়ায় প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনা অবস্থান করছে।
মধ্যপ্রাচ্যে আরও কয়েকটি ঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যার মধ্যে উপসাগরে তিনটি প্রধান বিমান ঘাঁটি এবং বাহরাইনে একটি বন্দর রয়েছে, যা ইউএস নেভাল ফোর্সেস সেন্ট্রাল কমান্ড এবং মার্কিন পঞ্চম নৌবহরের সদর দপ্তর হিসেবে কাজ করে।
ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স ইন ইরাক আসলে কারা?
গত রোববার টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স ইন ইরাক জর্ডানে হামলার দায় স্বীকার করে। এটি বলছে, সিরিয়া ও জর্ডানে শাদ্দাদি, রুকবান ও তানফ মার্কিন ঘাঁটি এবং ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলি তেল স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার জবাবে গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা শুরুর পর অর্থাৎ গত বছরের শেষের দিকে গোষ্ঠীটির উত্থান ঘটে। ইরাকে তৎপর ইরান সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত এই বাহিনী সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে।
'ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স ইন ইরাক' বলতে বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী যেমন- কাতাইব হিজবুল্লাহ, নুজাবা এবং কাতাইব সাইয়্যেদ আল-শুহাদাকে একসঙ্গে বোঝানো হয়, যাদের ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
মূলত যুক্তরাষ্ট্র যাতে নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর ওপর হামলার দায় চাপাতে না পারে সেজন্যই এই গ্রুপগুলোকে এই নামে ডাকা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে জবাব দেবে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ হামলাকে 'ঘৃণ্য ও সম্পূর্ণ অন্যায্য' উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইরান সমর্থিত উগ্র গোষ্ঠীগুলো এ হামলার জন্য দায়ী।
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র পছন্দমতো সময় ও পদ্ধতিতে দায়ী সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে।'
কিছু আইনপ্রণেতা এবং বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তারা ইরানি লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে হামলার আহ্বান জানানোয় হোয়াইট হাউস এখন হামলার প্রতিক্রিয়া জানাতে এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাকে এবং কোথায় প্রতিশোধ নিতে হবে, কোথায় আঘাত হানতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হামলা প্রতিহত করতে পারবে কি না, নাকি ওই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান আগুনে আরও ঘি ঢালবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা উপ-সহকারী মন্ত্রী মিক মুলরয় বিবিসিকে বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি, এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি সে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা পরিষ্কার যে যুক্তরাষ্ট্র না চাইলেও ইরান চায় গাজার যুদ্ধ যাতে এ অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। তারা শুধু সামরিক শক্তি ও বলপ্রয়োগকেই বোঝে। এখন সময় এসেছে এটাকে কাজে লাগানোর।'
তিনি যোগ করেন, 'মার্কিন প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইরানের অভ্যন্তরের স্থাপনাসমূহেকে লক্ষ্যবস্তু করার সম্ভাবনা বিবেচনাধীন রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।'
এছাড়া যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ওই অঞ্চলে উত্তেজনা কমানোর জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।