পতঙ্গ আসলে আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় না, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে: গবেষণা
আমরা প্রায়ই রাতে বারান্দার বা রাস্তার বাতির চারপাশে ঝাঁক ধরে পতঙ্গ ও অন্যান্য পোকামাকড়কে উড়তে দেখি। তবে এর কারণ হিসেবে এতদিন আমরা যা জানতাম, বিষয়টি মোটেই তা নয়।
সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে, পতঙ্গ আসলে কৃত্রিম আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় না, বরং বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পতঙ্গেরা আসলে আকৃষ্ট হয়ে আলোর শিখার দিকে ধাবিত হয় না, বরং কৃত্রিম আলোর চারপাশে একটি বিভ্রান্তিকর কক্ষপথে আটকা পড়ে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, মোশন-ক্যাপচার ক্যামেরা ব্যবহার করে এবং ইনফ্রারেড আলোকসজ্জা দিয়ে ছবি তুলে গবেষকরা দেখেছেন, পোকামাকড়গুলো যখন আলোর উৎসের চারপাশে ওড়ে, তখন তারা আলোর দিকে পিঠ কাত করে রাখে। এই ধারা বজায় রেখে অসহায় এই পতঙ্গেরা অদ্ভুত কক্ষপথ ও স্টিয়ারিং প্যাটার্ন তৈরি করে ওড়ে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, পতঙ্গের ওপর আলোর প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আলোক দূষণ বিশ্বব্যাপী পোকামাকড়ের সংখ্যা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কৃত্রিম আলো নিশাচর পোকামাকড়কে বিভ্রান্ত করে
কৃত্রিম আলো না থাকলে নিশাচর পতঙ্গেরা আলোর সবচেয়ে শক্তিশালী উৎসের দিকে তাদের পিঠ রাখে। কীটপতঙ্গরা আলোর সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস বলতে মূলত আকাশকে বোঝে থাকে।
এই বিবর্তনীয় কৌশলটি তাদের ওপরে কোন দিক তা নির্ণয়ে এবং রাতে ওড়ার সময় তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কীটতত্ত্ববিদ ও পোস্টডক্টরাল গবেষক এবং এই গবেষণার সহ-প্রধান লেখক স্যামুয়েল ফ্যাবিয়ান বলেন, পোকামাকড় যখন কৃত্রিম আলোর উৎসের পাশ দিয়ে যায়, তারা তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বিশ্বাস করে যে এটি মানুষের তৈরি আলোকিত আকাশ।
ফ্যাবিয়ান বলেন, 'পোকামাকড়গুলো সহজাতভাবে নির্ণয় করতে পারে না যে কোন দিক উপরে রয়েছে। এটি বোঝার খুব ভাল উপায় তাদের জানা নেই।... তাই তারা ধরে নেয় এই আলোর উৎসটিই উপরের দিক, যা পুরোপুরি ভুল। তারা কাত হয়ে ওড়ার ফলে একটি গোল বৃত্ত তৈরি করে, আর তারা এই বৃত্ত থেকে খুব কমই বের হতে পারে। যেমন: মানুষ মোটরসাইকেল চালানোর সময় একদিকে কাত হয়ে চালালে একটি বড় বৃত্তের মধ্যে ঘুরতে থাকে, এটিও তেমনি।'
কক্ষপথ ধরে ওড়া, নিশ্চল হয়ে যাওয়া, ডিগবাজি খাওয়া
গবেষক দলটি প্রজাপতি, মথ, মৌমাছি, বোলতা, ড্রাগনফ্লাইয়ের আচরণ ধারণ করে শত শত স্লো মোশন ভিডিও সংকলন করেছে।
গবেষকেরা দেখেছেন, পতঙ্গেরা সাধারণত দূরের আলোতে আকৃষ্ট হয় না। পোকামাকড়গুলো কেবল কাছাকাছি থাকা আলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিভ্রান্ত হয়।
ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির পোস্টডক্টরাল গবেষক যশ সন্ধি বলেন, 'মানুষ মনে করে তাদের বারান্দার আলো বা স্ট্রিট ল্যাম্পের আশেপাশে পতঙ্গেরা সোজাসুজি উড়ছে, বিষয়টি তা নয়।'
মিয়ামির ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে জীববিজ্ঞানের ডক্টরাল ছাত্র থাকাকালীন সন্ধি এই গবেষণায় অংশ নেন।
গবেষক দলটি আলোর উৎসের ব্যাপারে পোকামাকড়ের তিন ধরনের সাধারণ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছে। যার মধ্যে রয়েছে আলোর উৎসকে কেন্দ্র করে ঘোরা, স্টলিং (পতঙ্গটি আলোর উৎসের উপরে খাড়াভাবে উঠে যায়) এবং ডিগবাজি খাওয়া (যখন পতঙ্গটি উল্টে যায় এবং মাটিতে পড়ে)।
ফ্যাবিয়ান বলেন, ড্রাগনফ্লাইয়ের মতো দ্রুতগামী কিছু পোকামাকড় কয়েক মিনিটের জন্য কক্ষপথ ধরে আলোর উৎসের চারপাশে দ্রুত ওড়ে।
গবেষকরা দেখেছেন, যে আলোর উৎস সরাসরি নিচের দিকে মুখ করে থাকে, সেখানে কীটপতঙ্গের চলাফেরা তুলনামূলক কম ব্যাহত হয়েছে।
গবেষকরা একবার উঁচুতে একটি সাদা চাদরের নিচে আলো জ্বালিয়ে রাতের আকাশের বিভ্রম তৈরি করেছিলেন। এক্ষেত্রে তারা দেখেন, পতঙ্গেরা কোনো সমস্যা ছাড়াই উড়ে মাটিতে নামতে পেরেছে।
ফ্যাবিয়ান বলেন, পোকামাকড়গুলো যদি সহজাতভাবে আলোর সন্ধান করত, তাহলে তারা চাদরে আছড়ে পড়ত।
ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির কীটতত্ত্ব বিভাগের সংগ্রহ ব্যবস্থাপক ফ্লয়েড শকলি বলেন, 'মাটির কাছাকাছি কৃত্রিম আলোর উপস্থিতিতে উড়ন্ত পোকামাকড়ের আচরণ অভিন্ন এবং আশ্চর্যজনকভাবে জটিল; যা আগে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।'
শকলি এক ই-মেইলে জানান, 'আমরা দেখি পতঙ্গেরা সরাসরি আলোর দিকে উড়ে যাচ্ছে না, বরং কাত হয়ে লম্বভাবে অবস্থান করছে, যা তাদের মধ্যে আকর্ষণের বিভ্রম তৈরি করছে।'
অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে আরও কিছু তত্ত্ব
পতঙ্গেরা কেন আলোর উৎসের দিকে ধাবিত হয় এবং চারপাশে উড়তেই থাকে এ সম্পর্কে অতীতের তত্ত্বগুলোতে বলা হয়েছে, কীটপতঙ্গ তাপের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং প্রাণীগুলো; বিশেষত যাদের পূর্বপুরুষরা গুহা ও গাছের গর্তে বাস করত, মনে করে আলোর উৎসটি বাইরের দিকে পালিয়ে যাওয়ার পথ।
সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্বে বলা হয়েছে, পোকামাকড়গুলো চাঁদের সঙ্গে কৃত্রিম আলোর উৎসকে গুলিয়ে ফেলে। কারণ চাঁদকে তারা কম্পাস কিউ হিসেবে ব্যবহার করে।
ফ্যাবিয়ান বলেন, তবে এই পুররোনো তত্ত্বগুলো বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে হয় না।
আলোক দূষণ এবং পোকামাকড় হ্রাস
বর্তমানে বিশ্ব একটি নিঝুম 'রাত হারানোর ক্ষতি' হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে।
বিজ্ঞানীরা ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানান, আলোক দূষণ বছরে ২ দশমিক ২ শতাংশ হারে বেড়েছে।
ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশনের উদ্ধৃত ২০২২ সালের মার্চ মাসের একটি গবেষণাপত্রের তথ্যানুসারে, কৃত্রিম আলো বৃদ্ধি বন্যপ্রাণীর ওপর বেশ কয়েকটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যার মধ্যে আবাসস্থল হ্রাস এবং দল ভেঙে যাওয়া অন্যতম।
নতুন গবেষণার লেখকরা বলেছেন, আলোক দূষণ পোকামাকড় হ্রাসের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।
তারা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন।
ওই গবেষণায় বলা হয়, কৃত্রিম আলো মথের প্রজনন এবং লার্ভা বিকাশের আচরণকে প্রভাবিত করে।
ডোমব্রোস্কি বলেন, নতুন এই আবিষ্কার পোকামাকড়ের ওপর আলোক দূষণের প্রভাব কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে গবেষণার রসদ জোগাতে সহায়তা করতে পারে।
তিনি বলেন, 'আমি সবসময় পরামর্শ দিই, যদি আলোর ব্যবহার শেষ হয় তাহলে এটি বন্ধ করে রাখুন।'
সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি