পাকিস্তান: যেভাবে ইমরান খান ও নওয়াজ শরিফ দুজনই নিজেকে বিজয়ী দাবি করছেন!
পাকিস্তানের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খান উভয়ই নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী দাবি করেছেন।
বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে শরিফের দল একক দল হিসেবে সর্বাধিক আসন জিতেছে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়া কারাবন্দি খানের পিটিআই দলের প্রার্থীরা সামগ্রিকভাবে সর্বাধিক আসন জিতেছেন।
শরিফ বলেন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় তার দল জোট সরকার গঠনের জন্য অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা করবে।
বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, কোনো দলই হয়ত এককভাবে বিজয়ী হতে পারবে না। এ পরিস্থিতি গভীর মেরুকৃত রাজনৈতিক পরিবেশে ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদের সঙ্গে লড়তে থাকা দেশটির অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে।
বৃহস্পতিবার জঙ্গি হামলায় ২৮ জন নিহত হওয়ার ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পর ২৬৫টি আসনের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনের ফলাফল ঘোষণার পরই নওয়াজ শরিফ এ দাবি করেন।
অন্যদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৪৫ আসনের মধ্যে ৯৮টি আসন জিতেছে, যাদের বেশিরভাগই খানের অনুসারী।
নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) পেয়েছে ৬৯টি আসনে এবং বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫১টি আসনে জয় পেয়েছে। বাকি আসনে জয় পেয়েছে ছোট কিয়েকটি দল ও অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাহোরে নিজের বাড়ির বাইরে সমবেত সমর্থকদের উদ্দেশে নওয়াজ শরিফ বলেন, 'নির্বাচনের পর পাকিস্তান মুসলিম লিগ আজ দেশের একক বৃহত্তম দল এবং এই দেশকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।'
তিনি বলেন, 'স্বতন্ত্র হোক বা দলীয়, যারাই ম্যান্ডেট পেয়েছেন, আমরা জনগণের সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। আমরা তাদের আমাদের সঙ্গে বসতে এবং এই দুর্দশাগ্রস্ত জাতিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।'
ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল বার্তা প্রকাশ করেছে।
এতে ৭১ বছর বয়সী ইমরান খান নওয়াজ শরিফের জয়ের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তিনি নির্বাচনে নিজেকে 'জয়ী' দাবি করে তার সমর্থকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং এই জয় উদ্যাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বার্তায় বলা হয়েছে, 'আমি বিশ্বাস করেছিলাম আপনারা সবাই ভোট দিতে আসবেন এবং আপনারা সেই বিশ্বাসকে সম্মান করেছেন। আমাকে আপনাদের ব্যাপক ভোটদান সবাইকে বিস্মিত করেছে।'
এতে বলা হয়েছে, 'নওয়াজ শরিফের দাবি কেউ মেনে নেবে না, কারণ তিনি কম আসন জিতেছেন এবং নির্বাচনে কারচুপিও হয়েছিল।'
সাবেক ক্রিকেট সুপারস্টার খান গত আগস্ট মাস থেকে কারাগারে আছেন। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস, দুর্নীতি এবং অবৈধ বিয়ে সম্পর্কিত মামলায় নির্বাচনের আগে ছয়দিনের মধ্যে তিনবার ১০, ১৪ ও সাত বছরের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন তিনি।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ (৭৪) গত বছরের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যে চার বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে দেশে ফিরেছেন।
শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধের অবসান ঘটিয়ে তিনি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন বলেই ভাবা হচ্ছিল।
শুক্রবারই নওয়াজ শরিফ বলেন, তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে চায়, কিন্তু তা না হলে পিপিপি নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাতেই আলোচনা শুরু করবে।
জিও নিউজের খবরে বলা হয়েছে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইমরান খানের এক জ্যেষ্ঠ সহযোগী বলেন, পিটিআই নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন এবং ফলাফল নিয়ে আলোচনার জন্য শনিবার কারাগারে ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করবেন।
এবার পাকিস্তানে ভোটের ফলাফল ঘোষণায় অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ জন্য মোবাইল ফোন পরিষেবা বন্ধ থাকাকে দায়ী করেছে।
পাকিস্তানের জটিল নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে স্বতন্ত্র সদস্যরা নিজেরা সরকার গঠন করতে পারে না, যার মধ্যে সংরক্ষিত আসনও রয়েছে।
তবে নির্দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনের পরে যে কোনো দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
জোট গঠনে চ্যালেঞ্জ
মুডি'স ইনভেস্টরস সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সময়মতো ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে নতুন সরকার গঠন করা হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কমবে। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন দেশটির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফলাফল ঘোষণায় এই বিলম্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। এই অনিশ্চয়তার কারণে করাচির স্টক সূচক এবং পাকিস্তানের সার্বভৌম বন্ডের পতন হয়েছে।
আশা করা হচ্ছিল, মূল নির্বাচনী লড়াইটি হবে ইমরান সমর্থিত প্রার্থীদের ও পিএমএল-এন'র মধ্যে।
ইমরান খান বিশ্বাস করেন, তার দলের অস্তিত্ব বিলোপের জন্য করা অপচেষ্টার পেছনে সামরিক বাহিনীর হাত রয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্লেষক ও বিরোধীরাও বলছেন, জেনারেলরা শরিফকে সমর্থন দিচ্ছেন।
ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতার ৭৬ বছরের মধ্যে পরমাণু শক্তিধর দেশটিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর আধিপত্য থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে তারা বলে আসছে, তারা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জোট সরকারকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য লড়াই করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে নতুন সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে একটি নতুন বেলআউট প্রোগ্রাম চাইতে হবে। কারণ এসংক্রান্ত সমঝোতার মেয়াদ শেষ হবে তিন সপ্তাহের মধ্যে।
ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান স্টাডিজের পরিচালক মারভিন ওয়েইনবাউম বলেন,
জোট সরকার 'অস্থিতিশীল ও দুর্বল হতে পারে' এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে 'বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেনাবাহিনী।'
কারণ সেনাবাহিনী সত্যিকার অর্থে এই ভোট আয়োজনের সক্ষমতা প্রমাণে নিজেদের সুনাম বাজি রেখেছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তান যে সংকট মোকাবিলা করছে, এই নির্বাচন তা সমাধানে সহায়তা করবে বলে আশা করা হয়েছিল।
তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাহীন জনরায় 'অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী একটি বাহিনীর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাকে আরও গভীরতর ভিত্তি দিতে পারে।'