ঝড়ে ভেসে উঠল রহস্যময় এক জাহাজ, আরেক ঝড়ে এখন হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়!
গত মাসে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের একটি উপকূলে হঠাৎ একটি রহস্যময় জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে সমুদ্রের তলদেশ থেকে জাহাজটি স্থানচ্যুত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছোট শহর কেপ রে'র কাছে অগভীর পানিতে পড়ে থাকা জাহাজটির ধ্বংসাবশেষটি ২০ জানুয়ারি সকালে স্থানীয় এক বাসিন্দা আবিষ্কার করেন।
ক্লিন হারবারস ইনিশিয়েটিভের শন বাথ এবং ট্রেভর ক্রফট, উভয়ই এ খবর শোনার সাথে সাথে তাদের ডুবুরি সরঞ্জাম নিয়ে সৈকতের পথে রওনা দেন। তারা প্রথমে সাঁতার কেটে জাহাজটির চারদিকে ১০০ ফুট লম্বা ফ্রেমে দড়ি বেঁধে এটিকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করেন।
ট্রেভর সিএনএনকে বলেন, 'দুইশো বছরের মধ্যে আমরাই প্রথম এই জাহাজের ওপর দাঁড়িয়েছি, অভিজ্ঞতাটা দারুণ।'
২০২২ সালে কানাডার আটলান্টিক উপকূলে আঘাত হানা হারিকেন ফিওনার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের অংশ হিসেবে শন ও ট্রেভর দুই বছর ধরে এই অঞ্চলে কাজ করছেন।
শন মনে করেন, হারিকেন ফিওনা প্রাথমিকভাবে জাহাজের ধ্বংসাবশেষটিকে তার পূর্বের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। তারপরে ঝড় এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায় এটি ধীরে ধীরে নিউফাউন্ডল্যান্ড দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল রেখার দিকে সরে আসে। ঝড়ের কারণে জাহাজটি উপকূলে এসে ভিড়লেও এখন সে ঝড় থেকেই উপকূল বাসিরা এটিকে ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেপ রেতে খুঁজে পাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ একটি বৃহত্তর সমস্যাকে নির্দেশ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হওয়া ঝড়গুলো এভাবে জাহাজের ধ্বংসাবশেষের মতো ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো আবিষ্কার করার পাশাপাশি তাদের ক্ষতিসাধনও করছে।
তবে জাহাজটির উৎস ও বয়স এখনও অজানা। ক্রফট বলেন, 'আনুমানিক দুইশো বছরের পুরোনো এ জাহাজটি ফরাসি বা ব্রিটিশদের হতে পারে, তবে পানি থেকে না তোলা পর্যন্ত এটি নিশ্চিত করে বলে যাবে না।'
যুক্তরাজ্যের ক্র্যানফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষক ফেলো লিসা ব্রিগস জানান, এই ধ্বংসাবশেষটি উপকূল সম্প্রদায়ের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এর সূত্র ধরে এই দ্বীপে কীভাবে মানুষ এসে বসতি স্থাপন করেছিল তা নির্ণয় করা যাবে।
তিনি সিএনএনকে বলেন, 'সম্ভবত যারা এই জাহাজে এসেছিল তাদের বংশধররা আজও এই দ্বীপে বাস করে।'
কিন্তু জাহাজটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জোয়ারের পানিতে এরই মধ্যে অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে। জাহাজের কাঠের আবরণ এখনও ভালো থাকলেও জোয়ারের ঢেউয়ের কারণে এর তামা এবং পিতলের পিন আলগা হয়ে যাচ্ছে।
আর আগামী বুধবার সন্ধ্যায় ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস জাহাজটি ধ্বংসের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, কেপ রে'র আশপাশে ঘণ্টায় ২৫ মাইল বেগে ঝড়ো হাওয়া বইতে পারে এবং ২০ ফুট পর্যন্ত ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে।
ট্রেভর বলেন, 'ধ্বংসাবশেষটি প্রায় ভেঙে যেতে পারে।'
ধ্বংসাবশেষটি নিষ্কাশন ও সংরক্ষণের জন্য সরকারি তহবিল ছাড়াই শন এবং ট্রেভর 'গো ফান্ড মি' প্রচারণার মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তাদের লক্ষ্য হলো– জাহাজটিকে সমুদ্র থেকে টেনে তীরে নিয়ে এসে সংরক্ষণ করা এবং এটিকে এই প্রত্যন্ত সম্প্রদায়ের জন্য একটি পর্যটক আকর্ষণ হিসেবে প্রদর্শন করা।
ট্রেভর বলেন, 'এটি সময়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিযোগিতা।'
ব্রিগস বলেন, 'শতাব্দী ধরে সমুদ্রের তলদেশে ডুবে থাকা কোনো জাহাজের এভাবে উপরে ভেসে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তনকে ইঙ্গিত দেয়।'
জলবায়ু পরিবর্তন জাহাজডুবির জন্য বাড়তি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ধিত কার্বন দূষণ সমুদ্রের পানিকে আরও অ্যাসিডিক করে তুলছে, যা ধ্বংসাবশেষে থাকা দড়ি, পাল এবং টেক্সটাইলের মতো সূক্ষ্ম জৈব পদার্থের ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মহাসাগরগুলো উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে শিপ ওয়ার্ম (এক ধরনের সামুদ্রিক পোকা), যা একসময় কেবল উষ্ণ জলে পাওয়া যেত, শীতল অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। এটি শীতল অঞ্চলে জাহাজডুবির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৬ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আর্কটিক সমুদ্রতল থেকে উদ্ধার করা একটি কাঠের টুকরোতে জাহাজ খেকো পোকা আবিষ্কার করেন।
কেপ রেতে, ট্রেভর ক্রফ্ট এবং শন বাথ রহস্যময় ধ্বংসাবশেষ রক্ষার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। কাজটা তাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং জানিয়ে তিনি বলেন, 'এই ছোট্ট শহরে এত সুন্দর কিছু ভেসে এসেছে। ঝড় এটিকে ধ্বংস করার আগে এটিকে পানি থেকে টেনে তোলার জন্য আমরা অর্থ জোগাড় করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন