কীভাবে ৭০ বছর ধরে লোহার ফুসফুসে বেঁচে ছিলেন আলেকজান্ডার!
প্রয়াত হলেন সাত দশক ধরে কৃত্রিম লোহার ফুসফুস নিয়ে বেঁচে থাকা পল আলেকজান্ডার। 'লোহার ফুসফুসের মানুষ' বা 'ম্যান ইন দ্য আয়রন লাং' নামে পরিচিত পল ৭৮ বছর বয়সে জীবনের ইতি টেনেছেন।
১৯৫২ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হন তিনি। এই রোগের কারণে পলের ঘাড় থেকে পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে যায়। এ কারণে পৃথিবীর আলো বাতাসে মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। জীবন বাঁচাতে তখন চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে একটি লোহার সিলিন্ডারের ভেতর রাখা হয়। সেখানেই দীর্ঘ ৭০ বছরেরও বেশি পার করে দেয়ার পর অবশেষে মারা যান তিনি।
তহবিল সংগ্রহের একটি ওয়েবসাইটে এক পোস্টে বলা হয়, 'দ্য ম্যান ইন দ্য আয়রন লাং, পল আলেকজান্ডার গতকাল মারা গেছেন।'
ভাইকে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহজগম্য বর্ণনা করে ফিলিপ আলেকজান্ডার বলেন, 'এত কিছু নিয়েও পল কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন, আইন পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং একজন প্রকাশিত লেখকও হয়েছিলেন। তিনি সত্যিই একজন অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।'
বিবিসিকে তিনি আরও বলেন, 'অন্য সবার মতো আমাদের মধ্যেও স্বাভাবিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল। আমরা ঝগড়া করতাম, একসাথে খেলতাম, পার্টি করতাম, কনসার্ট উপভোগ করতাম। আমি তাকে কখনও অন্য চোখে দেখিনি, নিজের ভাই হিসেবেই দেখেছি।'
'শেষ মুহূর্তে তার সঙ্গে থাকতে পারাটা ছিল সম্মানের', যোগ করেন ফিলিপ।
১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় পোলিও প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশটিতে ৫৮ হাজারের বেশি মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিল। তখনও পোলিও রোগের টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ছিল শিশু। সে বছরই পোলিওতে আক্রান্ত হন পল। ছয় বছর বয়সেই প্যারালাইজড হয়ে যান তিনি। তার পিতামাতা নিয়ে যান তাকে পার্কল্যান্ড হাসপাতালে। শুরুতে ডাক্তাররা জানান তাদের পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব না।
পল নিশ্চিতভাবেই মারা যেতেন যদি না দ্বিতীয় আরেকজন ডাক্তার তাকে বাঁচাতে এগিয়ে না আসতেন। তিনি তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান এবং জরুরি ট্র্যাকিওটমি করেন। ফুসফুস থেকে জমা ফ্লুইড বের করে আনা হয়, জীবন রক্ষা পায় তার।
কিন্তু পলের জন্য এটি ছিল এক ভয়ংকর নতুন বাস্তবতা। চোখ খুলেই দেখেন একটি বদ্ধ লোহার খাঁচায় বন্দি হয়ে আছেন তিনি, কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। তারপর থেকে এই লোহার খাঁচাই তার জীবনের সঙ্গী।
তিনি ১৮ মাস ধরে সেখানে আটকে ছিলেন, পোলিও ওয়ার্ডে অন্যান্য বাচ্চাদের কান্নাকাটি শুনতে পেতেন তিনি। সেই ঘটনা স্মরণ করে পল একবার বলেন, 'যখনই আমি কোনও বন্ধু বানাতাম, তারা মারা যেত'।
পোলিওর কারণে বেশিদিন বাঁচবেন না বলে আশা করা সত্ত্বেও পল আলেকজান্ডার কয়েক দশক ধরে বেঁচেছিলেন। তবে কিছু সময়ের জন্য তিনি লোহার ফুসফুসের বাইরেও শ্বাস নিতে পারতেন তিনি, এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফ্রগ ব্রিথিং।
১৯৮৪ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। দুবছর পরে বারে ভর্তি হয়ে তিনি কয়েক দশক ধরে আইনজীবী হিসাবে অনুশীলন করেছিলেন।
২০২০ সালে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমি জানতাম আমি যদি আমার জীবন নিয়ে কিছু করতে চাই, তাহলে আমাকে মানসিক ভাবে আরও দৃঢ় হতে হবে।'
সেই বছর, তিনি একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করেছিলেন যা লিখতে তাঁর আট বছর সময় লেগেছিল বলে জানা গেছে। কিবোর্ডে লিখতে এবং বন্ধুকে দিক নির্দেশনা দিতে তিনি একটি প্লাস্টিকের লাঠি ব্যবহার করতেন।
পলের ভাই ফিলিপ বলেন, বইটি প্রকাশের পরই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার ভাই বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে কতটা অনুপ্রেরণা ছিলেন।
যদিও ১৯৬০-এর দশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে লোহার ফুসফুস অপ্রচলিত হয়ে পড়ে, ভেন্টিলেটর প্রযুক্তি চলে আসে। কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় লোহার সিলিন্ডারে বসবাস অব্যাহত রাখেন পল।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাকে লোহার ফুসফুসে সবচেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকা ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
কীভাবে কাজ করে এই আয়রন লাং?
আয়রন লাং বা লোহার ফুসফুস হল ৬০০ পাউন্ডের বিশাল একটি সিলিন্ডার। এটি একধরনের নেগেটিভ প্রেসার ভেন্টিলেটর যা কৃত্রিম ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে। ডিভাইসটি ভেতরের বেলো ব্যবহার করে আবদ্ধ অংশের বায়ুচাপের পরিবর্তনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ফুসফুসকে প্রসারিত ও সংকুচিত করে।
১৯২০ এর দশকে কয়লা গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আক্রান্তদের সহায়তার জন্য লুই আগাসিজ শ এবং ফিলিপ ড্রিঙ্কার এই যন্ত্রটি তৈরি করেছিলেন, তবে ১৯৪০ এবং ১৯৫০ এর দশকে গণ প্রাদুর্ভাবের সময় পোলিও আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসার জন্য এটি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছিল।
লোহার এ সিলিন্ডারের একপাশ খোলা থাকে যার মাধ্যমে মাথা উন্মুক্ত বাতাসের বাইরে বের করে রাখা হয় এবং শরীরের বাকি অংশ সিলিন্ডারের ভেতরে বায়ুবদ্ধ থাকে। প্রথমে সিলিন্ডার থেকে কিছু বাতাস বের করে কৃত্রিম শূন্যস্থান বা ভ্যাকুম তৈরি করে নেওয়া হয়। ভেতরে বায়ুচাপ বাইরে থেকে কম থাকায়, ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য রোগীর নাক ও মুখ হয়ে বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করে। এভাবে সম্পন্ন হয় শ্বাস গ্রহণ।
প্রশ্বাসের জন্য পুরো প্রক্রিয়াকে উলটো করে দেওয়া হয়। এবার সিলিন্ডারের বায়ুচাপ হালকা বাড়ানো হয়। ভেতরের বায়ুচাপ বাইরের থেকে বেশি থাকায় অতিরিক্ত বাতাস নাক ও মুখ হয়ে ফুসফুস হতে নির্গত হয়। এভাবে কৃত্রিম ভাবে ডিভাইসটি শ্বাস প্রশ্বাস চালনা করে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন