প্রতিদিন কী পরিমাণ পানি পান করা উচিত?
ক্লান্তি কিংবা শুষ্ক ত্বক থেকে পরিত্রাণ পেতে বেশি করে পানি পান করতে বলা হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বত্র পানির বোতল বয়ে নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আমাদের শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় চেয়ে বেশি পানি পান করার কারণ হতে পারে।
আগে পানি পান নিয়ে খুব একটা ভাবা হতো না। তবে সময় বদলেছে। এখন পানি পান করার স্বাস্থ্য সুবিধা, যেমন শক্তি বৃদ্ধি, উজ্জ্বল-উন্নত ত্বক, ওজন হ্রাস এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকায় এখন আগের তুলনায় পানি পানের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
দূরপাল্লায় যাত্রীরা বোতলে পানি নিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পানি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। অফিস মিটিংয়ে প্রায়শই টেবিলে পানির বড় জগ দেখা যায়।
পানির এই বর্ধিত চাহিদা বহুল প্রচলিত '৮x৮' নিয়মের কারণে। এই নিয়মানুযায়ী অন্যান্য পানীয় ছাড়াও প্রতিদিন ২৪০ মিলিলিটারের আট গ্লাস বা প্রায় দুই লিটার পানি খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে এই তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
পানি পান নিয়ে আগে নানা ধরনের অদ্ভুত ধারণা ছিল। বিশেষ করে ইউএস ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ডের ১৯৪৫ সালের এক সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি ক্যালরি খাবার গ্রহণের বিপরীতে এক মিলিলিটার পানি খাওয়ার পরামর্শ দেয়। এই হিসাব অনুযায়ী নারীদের ২০০০ ক্যালরি খাবারের বিপরীতে প্রায় দুই লিটার এবং ২৫০০ ক্যালরি খাবারের বিপরীতে পুরুষদের আড়াই লিটার পানি পান করা উচিত।
১৯৭৪ সালে পুষ্টিবিদ মার্গারেট ম্যাকউইলিয়ামস ও ফ্রেডরিক স্টেয়ার সুপারিশ করেন যে, গড় প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে ছয় থেকে আট গ্লাস পানি পান করা উচিত। এর মধ্যে ফল, সবজি, ক্যাফেইনযুক্ত ও কোমল পানীয়ও থাকতে পারে।
পানি পানের বিজ্ঞান
বিভিন্ন শারীরিক কার্যকলাপের জন্য পানি অপরিহার্য। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে পানি। এটি শরীরে পুষ্টি পরিবহণ, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পেশিগুলোর নড়াচড়া এবং ভেতরে চলমান বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো সহজতর করে।
ঘাম, প্রস্রাব ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে ক্রমাগত পানি বেরিয়ে যায়। তাই পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করতে পরিমিত পরিমাণে পানি পান করা অপরিহার্য।
আমাদের শরীর থেকে ১-২ শতাংশ পানি বেরিয়ে গেলে ডিহাইড্রেশন বা পানি শূন্যতা দেখা দেয়। পানি শূন্যতা তাৎক্ষণিক দূর করা না গেলে অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। পানি শূন্যতা অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
'৮x৮' নিয়মের পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে চলে আসা নানা তত্ত্ব অনুযায়ী অনেকে মনে করে যে, তৃষ্ণা অনুভব করার অর্থই হলো আপনি গুরুতর ডিহাইড্রেশন বা পানি শূন্যতায় ভুগছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমাদের শরীর হাইড্রেশন নিয়ন্ত্রণে পারদর্শী এবং আমাদের কেবল তখনই পানি পান করা উচিত যখন আমাদের শরীর পানির প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।
টাফ্টস ইউনিভার্সিটির প্রবীণ বিজ্ঞানী আরভিন রোজেনবার্গ আমাদের শরীরের হাইড্রেশন কন্ট্রোল মেকানিজমের উপর জোর দিয়ে জানান, সুস্থ শরীরের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক পানিশূন্যতা শনাক্ত করতে সক্ষম এবং সংকেত পাঠানোর মাধ্যমে মস্তিষ্ক আমাদের পিপাসা অনুভব করায়।
এদিকে লন্ডন ট্রায়াথলনের মেডিকেল ডিরেক্টর কোর্টনি কিপসের মতে, আমাদের শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখতে মস্তিষ্কের দেয়া তৃষ্ণার সংকেত যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য। গবেষণা অনুসারে ক্যালরি না থাকায় পানি হাইড্রেশনের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলেও অন্যান্য পানীয় যেমন চা, কফি ইত্যাদি পানীয় হাইড্রেশনে বা পানি শূন্যতা থেকে আমাদের দূরে রাখতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
গবেষণা অনুযায়ী, পর্যাপ্ত পানি পান পানিশূন্যতা মোকাবেলা করাসহ শরীরের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করে। পর্যাপ্ত হাইড্রেশন মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ঠিক রাখে, সম্ভাব্য বার্ধক্যকে মোকাবেলা করে এবং একইসাথে হার্ট ও ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী নানা রোগের ঝুঁকিও কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া ২০২৩ সালে ভার্জিনিয়া টেকের অধ্যাপক ব্রেন্ডা ডেভির পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যে, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণেও বিরাট ভূমিকা রাখে পানি।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক বারবারা রোলসের মতে, চিনি বা সুক্রোজযুক্ত কোন কোমল পানীয়ের পরিবর্তে সাধারণ পানি মূলত ওজন হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
বেশি পানি পান করার আরেকটি প্রচলিত স্বাস্থ্য উপকারিতা হলো ত্বকের রং উজ্জ্বল করা এবং ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখা। এই ধারণাকে সমর্থন দেয়ার মতো কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেও পর্যাপ্ত এটিকে পানি পানের সুফল হিসেবে ধরাই যেতে পারে।
অনেক বেশি পানি পান করা কি উচিত?
দৈনিক আট গ্লাস পানি পান করা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। আমাদের শরীরের চাহিদার থেকে বেশি পানি পান করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ প্রমাণ হতে পারে। অতিরিক্ত পানি পান করলে 'হাইপোনেট্রেমিয়া' হতে পারে। এতে করে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যায়; ফলে শরীরে পানির পরিমাণের তারতম্য ঘটে।
'হাইপোনেট্রেমিয়া'র কারণে মস্তিষ্ক ও ফুসফুস ফুলে যায়। বিভিন্ন খেলাধুলায় গত এক দশকে অতিরিক্ত হাইড্রেশনে প্রায় ১৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করে কোর্টনি কিপস। তার মতে, আমাদের নিজেদের তৃষ্ণার্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থার অভাবেই এধরণের ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আমাদের কী পরিমাণে পানি পান করা উচিত?
কেউ কেউ সবসময় পানির বোতল নিজেদের সাথে বহন করেন। প্রতিনিয়ত পানি পান করার ফলে তারা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পানি পান করে ফেলে।
লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর স্পোর্ট, এক্সারসাইজ অ্যান্ড হেলথের হিউ মন্টগোমারি ব্যাখ্যা দেয় যে, ঘাম এমনকি প্রচণ্ড গরমেও সাধারণত প্রতি ঘণ্টায় দুই লিটারের বেশি পানি পান করা হয় না। এনএইচএস প্রতিদিন ছয় থেকে আট গ্লাস তরল পানীয় বা পানি পান করার পরামর্শ দেয়। যার মধ্যে আছে দুধ, চা এবং কফির মতো পানীয়।
আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের তৃষ্ণার সংবেদনশীলতা হ্রাস পায়। এ কারণে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে পানিশুন্যতায় ভোগার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
২০২২ সালে গবেষকরা পানিশূন্যতার লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্রেন্ডা ডেভি জোর দিয়ে বলেন, "আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে পানি কিংবা পানি সমৃদ্ধ ফল-সবজি এবং অন্যান্য তরল খাদ্য গ্রহণের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত।"
বয়স, আকার, লিঙ্গ, পরিবেশ ও শারীরিক পরিশ্রমের ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে পানি পানের মাত্রা ভিন্ন হয়। রোজেনবার্গ ৮x৮ নিয়মের এত সহজ ব্যাখ্যা দেয়াকে সমালোচনা করেন।
২৩টি দেশের গবেষকদের সহযোগিতায় অ্যাবারডিন ইউনিভার্সিটি ২০২২ সালে করা একটি সমীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, দৈনিক ১.৫ থেকে ১.৮ লিটার পানি পান করা আমাদের শরীরের জন্য সবচেয়ে ভালো বলে প্রমাণিত হয়েছে।
জলবায়ু, উচ্চতা, শারীরিক পরিশ্রম এবং বয়স বা জীবনের নানা স্তর যেমন গর্ভাবস্থা, স্তন্যপান করানোর মতো পরিস্থিতিতে পানি পানের মাত্রা ভিন্ন হয়। কতটুকু শক্তি ব্যয় হচ্ছে তা মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এক্ষেত্রে। তাই সবাইকে এক-ছাঁচে না ফেলে প্রত্যেকের নিজ নিজ চাহিদা অনুযায়ী পানি পান করা উচিত।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, প্রত্যেকের প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পান করতে হবে এ ধরনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। ক্ষুধা বা ক্লান্তির মতোই আমাদের শরীর আমাদের পানির চাহিদার ব্যাপারে সংকেত দেয়। গবেষকদের মতে, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পানি পান করার ফলে অপকার হলেও আপাতত কোন উপকার আপনারা পাচ্ছেন না।
অনুবাদ: জেনিফার এহসান