ইসরায়েল, ইরান এবং গাজা নিয়ে শেষ ফয়সালা!
ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেউ নিহত হয়নি। ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে খুবই সামান্য। ৯০ শতাংশের বেশি ড্রোনও ভূপাতিত করা হয়েছে। যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা শক্তি ও সামর্থ্যকে তুলে ধরেছে। নেতানিয়াহুকে এই জয় গ্রহণ করে, ইরানে পাল্টা-আক্রমণ না করার কথাই বুঝিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আপাতত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা শুনেছেন বলেই মনে হচ্ছে।
ইরানি হামলার দুর্বল পারদর্শিতার কারণ হিসেবে পর্দার অন্তরালে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে আলোচনার বিষয়টি থাকতে পারে। কারণ, ১ এপ্রিল সিরিয়ার কনস্যুলেটে হামলার দুই সপ্তাহ পরে ইরান তার জবাব দেয়। মাঝখানের দুই সপ্তাহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরালো করার সময় ছিল। তাছাড়া, হামলার আগে তেহরানই ওয়াশিংটনকে সতর্ক করেছে।
এই অবস্থায়, পাল্টাপাল্টি হামলা বন্ধ হলে– তা আলোচনার পথ উন্মুক্ত করবে। এডেন উপসাগরে হুথিরা ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধা দিচ্ছে। তেহরানের সাথে সংলাপ, হুথিদের তৎপরতা বন্ধে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর একবার লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল পূর্ণদ্যমে আগের গতিতে ফিরলে, কমবে বিমার প্রিমিয়াম, জ্বালানি তেলের দরেও হবে পতন, তার ফলে নামবে মূল্যস্ফীতিও।
তখন সুদহার কমাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) ফেডারেল রিজার্ভ। এতে আমেরিকান মধ্যবিত্ত শ্রেণিসহ পুরো বিশ্বের মানুষই যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সুফল পাবে।
ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করেন, ইরানি হামলার শক্ত জবাব দিতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে এ ধরনের দুঃসাহসী আক্রমণ থেকে তেহরানকে নিবৃত্ত রাখা যাবে। এতে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মধ্যে থাকা, শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অসন্তুষ্ট এবং ইসরায়েলের প্রতিহিংসার আতংকে ভীত অনেক ইরানি নাগরিক সরকারের বিরুদ্ধাচারণে নামবে।
তবে ইসরায়েলিদের মনে রাখা উচিত, প্রতিহিংসা মোক্ষম সময়ে চরিতার্থ করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতে কিছু সময়ের বিরতিকে বেইজিং-ও স্বাগত জানাবে। নানান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করছে চীন, এবং মধ্যপ্রাচ্যের একটি সংঘাতে সে আমেরিকা বা ইরানের মধ্যে কোনো একটি পক্ষালম্বন করতে চায় না।
মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ক্রমবর্ধমান চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বেইজিংয়ের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনার জন্যও এই অঞ্চল অসীম গুরুত্বের। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সামান্য পরিমাণ শান্তি ও স্থিতিশীলতাও এই বাণিজ্য রক্ষার অনুকূল হবে।
তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীন-বিরোধ কতোটা বাড়বে, তা নির্ভর করছে চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরলে বেইজিং বিরোধিতা বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। তাই কিছু ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে, আপাতত বাইডেন প্রশাসনের সাথে সার্বিকভাবে যতোটা সম্ভব উত্তেজনা পরিহার করছে বেইজিং।
এজন্যই বেইজিং সমস্ত দুয়ারই খোলা রাখতে চায়। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে একটি সমঝোতার মাধ্যমে, অথবা রাশিয়ার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হোক- সেটাও চীনের কাম্য নয়। কিন্তু, মধ্যপ্রাচ্যে চীন যুদ্ধের বিরোধী। সংঘাত আরো ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বেইজিংকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ নিতে পারে ওয়াশিংটন।
এই অবসরে গাজা ও ইসরায়েলের বিষয়ে ভাবার সুযোগ পাওয়া যাবে। কারণ, হামাসকে ইরান ও তাঁর আঞ্চলিক মিত্রদের সহায়তা থেকে বঞ্চিত করতে পারাটা– যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য বড় বিজয় হবে। এই ঘটনা হামাসের জন্য হবে এমন মারণ আঘাত, যা ইসরায়েল সামরিক পদক্ষেপ নিয়েও অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য তাতে, গাজা ভূখণ্ডের জটিল রাজনৈতিক ও মানবিক সংকটের সুরাহা হবে না। সেজন্য ভিন্ন প্রক্রিয়া তখন দরকার হবে।
তবে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের সাথে রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধকে একই সমান্তরালে তুলনা করা হচ্ছে। কারণ যুদ্ধ হলো পেশিশক্তির জোরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলেরই আরেক পথ। আগামী মাসগুলোয় ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় রাশিয়াকে এক অর্থে নাকেখত দিতে হয়েছে। তবে একইকথা গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের বেলাতেও প্রযোজ্য।
সে যাই হোক, মস্কো আপাতত চায় ইউক্রেনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ইউরোপীয় ইউনিয়নে বিভাজন তৈরি এবং ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে হটাতে। এর কোনোটিই এপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ন্যাটো সামরিক জোট বরং আরো সম্প্রসারিত হয়েছে, রুশ হুমকি মোকাবিলায় আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। সামরিকভাবে রাশিয়া এই পর্যায়ে পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে বলেও মনে হয় না। তবে যুদ্ধে ইউক্রেনের পরাজয় হলে– তখন ইউক্রেনকে ক্রেমলিনের বশ্যতা স্বীকার করতেই হবে।
গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ইসরায়েলরও কিছু সমস্যা আছে। টানা ছয় মাস নির্বিচার গণহত্যা ও ধবংসযজ্ঞ চালিয়েও স্থল অভিযানের ঘোষিত লক্ষ্য– হামাসকে নির্মুল করা– ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে ইসরায়েলের।
একথা অবশ্য সত্য যে, হামাসকে রক্ষায় আরব ও মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক গণজাগরণ হয়নি। বরং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের বংশবদ আরব রাজতন্ত্রগুলো ইসরায়েলের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকেই সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। হামাসের ইসলামপন্থী রাজনীতি আরব স্বৈরশাসকদের চোখের বিষ। ইসরায়েলের হাতে হামাসের ধবংস তারাও কামনা করে। এবং ইহুদিবাদীদের মতোই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে হামাসের নাম ও নিশানা মুছে ফেলতে চায়।
ভবিষ্যতেও এসব আরব শাসকদের সঙ্গে নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে এগোতে চায় ইসরায়েল। করতে চায় সামরিক শক্তিতে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল। এজন্য ইরানের সাথে সংঘাতে ইতি টানায় আপাতত তার পক্ষে অনুকূল হবে।
তাছাড়া, শুধু যুদ্ধের ময়দানেই নয়, বিশ্ব জনমতের লড়াইয়েও হারছে ইসরায়েল। সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে তেল আবিবকে। খোদ ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম হারেৎজ-ই বলছে, বিশ্ব জনমতের লড়াইয়ে ইসরায়েল পরাজিত হচ্ছে।
প্রভাবশালী গণমাধ্যমটির মতে, "আমরা হেরেছি, এই সত্যকে বলতেই হবে। এই অস্বীকারের ঘটনার মধ্যে দিয়েই সবাই ইসরায়েলিদের জাতিগত মানসিকতাকে পুরোপুরি বুঝতে পারছে। অথচ এই সুস্পষ্ট, তীক্ষ্ম ও পূর্বানুমিত বাস্তবতাকে আমাদের গভীরভাবে উপলদ্ধি করা উচিত। যেন এই প্রক্রিয়ায় আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারি।"
সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করে হামাসকে নির্মুল করার যে দৃষ্টিভঙ্গি ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকদের– তার বিপক্ষে এই মত এক গুরুত্বপূর্ণ সংলাপের বার্তা দেয়। ইসরায়েলকে অবশ্যই নিজ দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত অর্জন করতে হবে। আর সেটা কেবল ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই নয়, বরং তার মিত্রদের নিজস্ব বৈশ্বিক অবস্থান ধরে রাখার জন্যও অপরিহার্য।
পশ্চিমা বিশ্বে ফিলিস্তিনপন্থী ও যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ যখন চলছে, তারমধ্যে জার্মানির এএফডির মতো কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ইসরায়েলকে একনিষ্ঠ সমর্থন দেওয়ার কথা বলছে। অথচ এই দলের রয়েছে বিতর্কিত সব রাজনৈতিক অবস্থান এবং ইহুদি বিদ্বেষের সাথে জড়িত থাকার ইতিহাস। এসব ঘটনাও ইসরায়েলের দাবিগুলোর ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে।
এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থনে ভাটা পড়তে পারে।
পরিমার্জিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদে: নূর মাজিদ
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।