মানুষের মতোই মৌমাছিও পারে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে
স্থাপত্যকাজে প্রাণিজগতে নিজেকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে মানুষ। কিন্তু, এই ধারণার মাধ্যমে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসকারী কীটপতঙ্গের বিস্ময়কর সব অর্জনকে খাটো করা হয়। বহুতল অট্টালিকার মতোন স্তরে স্তরে তাঁদের ঢিবি তৈরি করে উইপোকারা। আবার অসাধারণ জ্যামিতিক নকশায় চাক বানায় মৌমাছির দল। তবে কীটপতঙ্গ জগতের সেরা স্থাপত্যবিদ হলো হুলবিহীন শত শত প্রজাতির মৌমাছি, এরা মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের স্থানীয় প্রজাতি। গাছের ফাঁপা গুঁড়ি বা ফোকরের ভেতরে অতুলনীয় বৈচিত্র্য এবং জটিলতার চিরুনি বুননে মৌচাক নির্মাণ করে এরা।
সম্প্রতি ভিভিয়েনা ডি পিয়েত্রোর নেতৃত্বে একদল বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী নতুন এক আবিষ্কার করেছেন এদের সম্পর্কে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, খুদে মাথার হলে কি হবে, এই মৌমাছিরা ভিন্ন ভিন্ন স্থাপত্য ঐতিহ্য অনুসারে চাক বানাতে পারে। আর এই স্থাপত্যশৈলী আগের প্রজন্মের থেকে পায় নতুন প্রজন্ম। অর্থাৎ, স্থাপত্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটি তারা বংশপরম্পরায় ধরে রাখছে।
বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কারের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, বৈজ্ঞানিক জার্নাল কারেন্ট বায়োলজিতে। যেটি কীটপতঙ্গদের মধ্যে স্বপ্রণোদিতভাবে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা তৈরি হওয়ার ইঙ্গিতও দেয়। অথচ এক সময় মনে করা হতো পতঙ্গদের মধ্যে সংস্কৃতি বলে কিছু থাকাই অসম্ভব। একথা বলেন, ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট অ্যান্ডুজের জীববিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু হুইটেন, যিনি নিজে এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন না। তাঁর মতে, "মাত্র এক শতাব্দী আগেও ভাবা হতো শুধুমাত্র মানুষেরই সংস্কৃতি আছে।"
ডি পিয়েত্রো ও তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানীদের গবেষণার কথায় ফেরা যাক। তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা ব্রাজিলের একটি বিরাট মৌমাছির আবাস এলাকায় ২০২২ ও ২০২৩ সালের একটি বড় সময় কাটান। এখানকার স্ক্যাপ্টোট্রিগোনা ডেপিলিস নামের হুলবিহীন মৌমাছি প্রজাতির চার শতাধিক কলোনি পর্যবেক্ষণ করেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা দেখেন ৯৫ শতাংশ কলোনি বা মৌচাক গড়ে উঠেছে একটার ওপর আরেকটা– এমন স্তরে স্তরে। বাকিগুলো ছিল প্যাচানো কাঠামোর। কিন্তু, উভয় ক্ষেত্রেই মৌমাছিরা বহু প্রজন্ম ধরে একই ধাঁচে চাক নির্মাণ করেছে। অর্থাৎ, কর্মী মৌমাছিরা পূর্বপুরুষের স্থাপত্যশৈলীকে বজায় রেখেছে নতুন চাক নির্মাণের সময়ে।
স্তরে স্তরে উপরমুখী চাক নির্মাণই বেশি পছন্দ করে সি. ডেপিলিস প্রজাতি। তাই প্যাচানো চাক যে আদৌ আরেকদল নির্মাণ করছে– সেটিই ছিল ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর। মৌমাছিদের চাক নির্মাণের ভিডিও ধারণ করেন বিজ্ঞানীরা। এতে দেখা যায়, দুই ধরনের স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে গড় নির্মাণ গতিরও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ফলে এক ধরনের নকশার তুলনায় অন্যটি নির্মাণ করা যে বেশি সহজ বা কার্যকরী– এমনটাও নয়।
বিজ্ঞানীরা তখন ভাবলেন, জিনগত কোনো ভিন্নতার কারণেও হয়তো ভিন্ন ভিন্ন নকশার চাক তৈরি করছে মৌমাছিদের দুটি দল। বিষয়টি আসলেই কী বের করার এক ফন্দি আটলেন তাঁরা। এজন্য প্রথমেই এক নকশায় গড়া চাক থেকে পূর্ণবয়স্ক মৌমাছিদের সরিয়ে নিয়ে সেখানে ভিন্ন নকশার চাকের কর্মী মৌমাছিদের নিয়ে আসেন। আমদানি করা এই কর্মীরা খুব শিগগিরই তাদের স্থানীয় স্থাপত্যশৈলীতে ফিরে যায়। চাকের লার্ভারা পূর্ণবয়স্ক কর্মীতে পরিণত হওয়ার পরে এই স্থাপত্যশৈলীকে স্থায়ী রূপ দেয়।
ভিভিয়েনা ডি পিয়েত্রো যে ল্যাবরেটরির ডক্টরেট শিক্ষার্থী, সেটির পরিচালক টম ওয়েন্সেলার্সে মনে করেন, পূর্বসূরীদের করা নির্মাণকাজে সূক্ষ্ম কোনো ত্রুটি মোকাবিলা করার উপায় হিসেবে ওই মৌমাছিরা তাদের নির্মাণশৈলী বদলে থাকতে পারে। এ ধরনের প্রক্রিয়া স্টিগমার্জি হিসেবে পরিচিত, যেখানে একাধিক জীব পরোক্ষভাবে তাদের পরিবেশে যে চিহ্নগুলি রেখে যায় তার মাধ্যমে একে অপরের (এইক্ষেত্রে এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মের) আচরণকে প্রভাবিত করে। মৌমাছি কলোনিগুলোর স্থাপত্য নকশার প্রভেদের জন্য স্টিগমার্জি-ই আসলে ভূমিকা রেখেছি কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য গবেষকরা খাঁড়া বা অনুভূমিক-স্তরের চাকগুলোয় কিছুটা বাকানো ভাব যুক্ত করেন, এতে নির্মাণশৈলী বদলে প্যাচানোভাবে চাক নির্মাণ করে মৌমাছিরা। ড. ওয়েন্সেলার্সের অনুমানের পক্ষে যা শক্তিশালী প্রমাণ।
গবেষণার এই ফলাফল জীব সংস্কৃতির পর্যবেক্ষক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তাঁরা বলছেন, হুলবিহীন মৌমাছিদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের স্থাপত্যশৈলী এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে আসে, সেক্ষেত্রে আগের প্রজন্মের থেকে হাতেকলমে শিখতে হয় না নতুনদের। সংস্কৃতির বিষয়ে এটি আমাদের আগের ধারণাকে অনেক প্রসারিত করেছে– কারণ আমরা মনে করি, সংস্কৃতি একজনের দেখাদেখি অন্যজন শিখতে থাকে, এবং তা এক পর্যায়ে গোষ্ঠীবদ্ধ একটি সমাজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।
জীববিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু হুইটেন বলেন, নতুন এই গবেষণার ফল ইঙ্গিত দেয় বিভারদের নদীতে বাঁধ নির্মাণ বা শিম্পাঞ্জিদের বাসা নির্মাণের মতো ঘটনাও আসলে এই পরোক্ষ যোগাযোগের মাধ্যমে ঘটেছে। তবে এখনই তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, অবশ্য এমনও হতে পারে কিছু মানুষের মধ্যেও এই ধরনের স্টিগমার্জি'র ধারাবাহিকতা রয়েছে।
মৌমাছিরা অবশ্য প্রাণিজগতের এক বিস্ময়। এর আগে গবেষণাগারে ভিমরুলের ওপর করা পরীক্ষায় আচরণগত পরিবেশবিদ লার্স চিটকা দেখেন যে, তারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে শিখতে পারে। অর্থাৎ আগের প্রজন্মের উদ্ভাবন শেখা এবং তা আরো এগিয়ে নিতে পারে তারা।
এই ধরনের গোষ্ঠীবদ্ধ সংস্কৃতির জন্য সামাজিক শিক্ষা একান্ত আবশ্যক। আগে আমাদের ধারণা ছিল এটা একমাত্র মানুষেরই আছে। কিন্তু, জীববিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারগুলো আমাদের চোখ খুলে দিচ্ছে। যেন বলছে, সর্বদিক দিয়ে নিজেদের এতটাও শ্রেষ্ঠ ভাবা হয়তো যৌক্তিকও নয়।
অনুবাদ: নূর মাজিদ