জাপানের যে ঘড়ি জাদুঘর সত্যিকার অর্থেই সময় ধরে রাখে
জাপানের আল্পস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত মাতসুমোটো শহর ঘুরতে যাবার অনেক উপলক্ষ্য থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে পার্বত্য এই অঞ্চলে অধিকাংশ দর্শনার্থী দেশটির ১৬ শতকের অন্যতম প্রাচীন দুর্গ কিংবা প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করতে যান।
কিন্তু জাপানের ঘড়ি অনুরাগীদের অনেকেই হয়ত জানেন না যে, সেখানে রয়েছে মাতসুমোটোতে টাইমপিস মিউজিয়াম। এটি মূলত একটি তিন-স্তরবিশিষ্ট উজ্জ্বল প্রদর্শনী স্থান; যেখানে সংগ্রহে থাকা ৮০০ ঘড়ির মধ্যে প্রায় ১২০টি ঘড়ি প্রদর্শিত রয়েছে।
জাপান ক্লক অ্যান্ড ওয়াচ অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, জাদুঘরটি জাপানের অ্যান্টিক ঘড়ির সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সংগ্রহশালার মধ্যে একটি। যেখানে দর্শনার্থীরা পেন্ডুলামের গতিবিধি ও ঘণ্টার শব্দ উপভোগ করতে পারে। আর এদিকে ঘড়ির কাঁটা যখন ঘণ্টায় কোঠায় পৌঁছে তখন এসব পেন্ডুলামের বিকট আওয়াজে চারিদিকে মুখোরিত হয়ে ওঠে।
অন্য ঘড়ি জাদুঘর থেকে এটি বেশ অনন্য। কেননা সেখানে থাকা ঘড়ির বেশিরভাগই কাজ করে। জাদুঘরটির কিউরেটর শুন কোবায়শি বলেন, "বিশ্বজুড়ে থাকা অন্য সব ঘড়ির জাদুঘরের জন্য এই বিষয়টি বেশ বিরল।"
জাদুঘরটি সংগ্রহের প্রাচীনতম ঘড়িটি হলো ১৪০০ দশকের একটি 'হাওয়ার গ্লাস' ঘড়ি। আর সবচেয়ে নতুন সংযোজন হল সাম্প্রতিক ক্যাসিও ও সিটিজেন টাইমপিস। এর মধ্যে সবগুলো জাপানে তৈরি হয়নি; ফ্রান্স, জার্মানি ও চীনসহ অন্যান্য আটটি দেশে তৈরি ঘড়িও রয়েছে।
১৯৭৪ সালে একজন প্রকৌশলী ও উৎসাহী ঘড়ি সংগ্রাহক চিকাজো হোন্ডা প্রায় ১২০টি ঘড়ি দান করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে সংগৃহীত সেই ঘড়িগুলো নিয়েই যাত্রা শুরু করে জাদুঘরটি।
চিকাজো জাপানের দক্ষিণে কাগোশিমায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। টোকিওতে থাকাকালীন তিনি প্রচুর সংখ্যক ঘড়ি সংগ্রহ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মাতসুমোটো থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩০ মাইল) দূরের একটি শহর সুওয়াতে চলে যাওয়ার সময় ঘড়িগুলোকেও সাথে নিয়ে যান তিনি।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে চিকাজো সুওয়া শহরকে তার ঘড়িগুলো দান করার কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু শহরটিতে এমন কোনো ঘড়ি প্রস্তুতকারক ছিল না যারা প্রাচীন ঘড়ি মেরামত করতে জানতেন। এদিকে মাতসুমোটোতে অবশ্য ঘড়ি প্রস্তুতকারক ও দোকান উভয়ই ছিল। সেকারণেই ১৯৮৫ সালে তার মৃত্যুর আগে তার সংগৃহীত ঘড়িগুলোর স্থান হয় মাতসুমোটো সিটি মিউজিয়াম অব আর্টে।
অন্যান্য নাগরিকরাও ঘড়ি দান করতে শুরু করলে শহরটি জাদুঘর তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে ২০০২ সালে চালু হয় ঘড়ির এই জাদুঘরটি। মাতসুমোটো শহর কর্তৃপক্ষ জাদুঘরটিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে চলেছে। এছাড়া জাদুঘরটিতে প্রবেশ করতে গুণতে হয় ৩১০ ইয়েন বা দুই ডলার।
বরফের মধ্যেও ঘড়ির এই জাদুঘরটি নজর কাড়তে বাধ্য। মেটোবা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের সামনে পাঁচ-মিটার-লম্বা (১৬.৫ফুট) পেন্ডুলামটি অবিরামভাবে গতিশীল। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পেন্ডুলামটি জাপানের অন্যতম বৃহত্তর পেন্ডুলামগুলোর মধ্যে একটি।
নিচের তলাটা সময় সম্বন্ধীয় ইতিহাসের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। সেখানে নানা প্রদর্শনীর মাধ্যমে টাইমপিস বা ঘড়ির বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু উপরে প্রদর্শিত হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘড়িগুলো। তবে উপরের এই তলাটি শুধু গ্রীষ্মে বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য খোলা রাখা হয়।
কোবায়াশি জানান, একে পুরানো টাইমপিস রোড বলা হয়। ১৭টি লম্বা কেস ঘড়ি দিয়ে সাজানো হয় হলের পথ। এসব ঘড়িকে সাধারণত 'গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক' বলা হয়৷ তাদের মধ্যে একটি ১৯ শতকে ফ্রান্সে তৈরি, একটি বালিঘড়ি বা আওয়ার গ্লাস আকৃতির, স্বর্গীয় দূতের আঁকা ছবি দিয়ে সজ্জিত এবং দুই মিটারেরও বেশি লম্বা।
হলের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে চিকাজো হোন্ডার একটি আবক্ষ মূর্তি। জাদুঘরটিতে সংগ্রহে এখনও হোন্ডার তৈরি একটি ঘূর্ণায়মান বল ঘড়ি টুকরো রয়েছে বলে জানান কোবায়াশি।
"হোন্ডার তৈরি ঘড়িতে একটি ছোট পিতলের বল একটি আঁকাবাঁকা খাঁজে এপাশ থেকে ওপাশে যায়," ঘড়িটির বর্ণনা দিচ্ছিলেন কিউরেটর। "যখন বলটি শেষ প্রান্তে পৌঁছায়, তখন এটি একটি লিভারে আঘাত করে, যা প্লেটের দিক পরিবর্তন করতে মেইনস্প্রিংয়ের শক্তি ব্যবহার করে বলটিকে বিপরীত দিকে নিয়ে যায় এবং ১৫ সেকেন্ড এগিয়ে দ্বিতীয় হাতটিকে এগিয়ে দেয়।"
তিনি বলেন, "একদিনে বলটি ৫,৭৬০ বার রাউন্ড ট্রিপ দেয় বা ঘোরে। চিকাজো হোন্ডা এই ধরনের ঘড়ির ব্লুপ্রিন্ট পাওয়ার জন্য নানা জায়গায় খুঁজে বেরিয়েছেন আর শুধু একটি ব্লুপ্রিন্ট দেখে তিনি এই ঘড়িটি তৈরি করেছিলেন।"
কিয়োটোর একজন ঘড়ি প্রস্তুতকারক মাসামিচি নাকানো জানান, ১০ বছরেরও বেশি সময় আগে জাদুঘর পরিদর্শনের সময় ঘূর্ণায়মান এই বল ঘড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি কিয়োটোর পূর্বে অবস্থিত সাগা প্রিফেকচারের ওমি ঘড়ি তৈরির স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
নাকানো বলেন, "প্রথমবারের মতো আমি এই ধরনের কোন ঘড়ি দেখেছিলাম। ঘড়িটি তখন চলমান অবস্থায় ছিল, আমিও পুরো সময় এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করি।"
এরপরের রুমে রাখা আছে ওয়েস্টার্ন টাইমপিসগুলো। এদের মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানিতে তৈরি ঘড়ি। পাশাপাশি স্থান করে নিয়েছে জাপানে তৈরি পশ্চিমা-শৈলীর ঘড়ি।
প্রদর্শনীতে রাখা ছিল 'উলটো ঘড়ি'। রুমের আয়না ব্যবহার করে ঘড়িটা সহজে দেখার পরামর্শ দিয়ে কোবিয়াশি বলেন, "এই ঘড়িটি ছিল একটি নাপিতের দোকানের। যেহেতু সাধারণত সেখানে সবাই আয়না থেকে ঘড়ি দেখে।"
রুমের ছাদের উপর থেকে একটি ঝাড়বাতি ঘড়ি ঝুলছিল। বিস্তৃত এই আলোকসজ্জার সাথে ছিল একটি বড় ঘড়ি। ঘাড় উঁচিয়ে তাকালেই দেখা মিলবে সেই ঘড়ির।
অন্যান্য মজার ঘড়িগুলোর মধ্যে একটি ছিল উড়ন্ত বলের পেন্ডুলাম ঘড়ি, যা 'টর্শন ঘড়ি' নামেও পরিচিত। ঘড়িটিতে আছে একটি ছোট পিতলের বল; যা একটি তারের সাথে সংযুক্ত থেকে চারপাশে ঘোরে। এর মাথার উপরে কোন আপাত কারণ ছাড়াই দেয়া হয়েছিল একটি ছাতা। ঘড়ির এই মডেলটি জাপানে তাইশো যুগে (১৯১২-২৬ সালের মধ্যে) তৈরি করা হয়েছিল।
এর পাশেই রাখা ছিল একটি সুইং ঘড়ি। একই সময়ের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এই ঘড়িটিও। দোলনায় বসে থাকা একটি শিশুর দোল খাওয়ার সিরামিক চিত্রটি ছিল টাইমপিসের নিচে। এর কাছেই ছিল রোলস-রয়েসের আকৃতির একটি ঘড়ি। একইসাথে রাখা হয়েছিল জাপানের শোভা যুগে (১৯২৬-৮৯) তৈরি আদুরে পেঁচা আকৃতির একটি দেয়াল ঘড়ি ।
এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি জার্মানি থেকে আসলেও কিছু ঘড়ি তৈরি করেছিল জাপানের 'সিটিজেন' প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে কাচ-ঢাকা ডিসপ্লেগুলোতে সাজানো ছিল পকেটঘড়ি। কিছু কিছু ঘড়িতে খুবই জটিল এবং নিখুঁতভাবে বসানো হয়েছে রত্ন বা এনামেল। এদের নিপুণ এই কৌশল চোখে পড়বে খুলি আকৃতির একটি ঘড়িতে।
জাদুঘরটির 'ওয়াডোকি ঘর' বা 'জাপানে তৈরি ঘড়ির ঘর' সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগৎ। যেহেতু জাপান ১৭ শতকের গোড়ার দিক থেকে ১৯ শতকের বেশ অনেকটা সময় পর্যন্ত বাকি বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, সেখানের ঘড়ি নির্মাতারা তাই সময় বলার নিজস্ব একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছিল।
কোবায়শি বলেন, "দিনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। রাত ও দিনের বেলা এবং তাদের প্রতিটি ছয়টি অংশে বিভক্ত। এদের দৈর্ঘ্য ঋতুর সাথে পরিবর্তিত হয়।"
রুমটিতে প্রায় ২০টি ঘড়ি প্রদর্শিত হয় যেগুলোতে সময় বলার এই ভিন্ন ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ঘড়িতে আছে ত্রিভুজাকার বেস এবং ডায়ালগুলো ১২টি চীনা রাশির চিহ্ন দ্বারা সজ্জিত; প্রতিটি ঘণ্টায় যুক্ত করা হয়েছে রাশিচক্রের চিহ্ন।
কোবায়াশি বলেন, "এগুলো এডো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) তৈরি করা হয়েছিল। সেসময় শুধু ধনী লোকেরাই, যেমন ডেইমিও, সামন্ত প্রভুরাই এসব ঘড়ি পড়তে পারতো। তবে এডো পিরিয়ডের মাঝামাঝি সময়ের একটি ধূপঘড়ি ছিল এই কক্ষটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। চীনে উদ্ভাবিত, পূর্ব-পরিমাপিত পথ বরাবর গুঁড়ো ধূপ জ্বালিয়ে সময় পরিমাপ করাই এই ঘড়ির বৈশিষ্ট্য। এই ধূপঘড়িগুলো আজও ব্যবহৃত হয় মন্দিরগুলোতে।"
এগুলো ছিল জাদুঘরের সচল ঘড়ির একটি উদাহরণ। যা অন্যান্য ঘড়ির জাদুঘর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্থক্য।
কিউরেটরের ভাষ্য মতে, জাদুঘরের প্রথম দিন থেকেই ঘড়ি সংগ্রহের ক্ষেত্রে এসব বিষয় লক্ষ্য রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, "চিকাজোর জন্য ঘড়িগুলো যদি সচল থাকে তবেই তা সার্থক৷ ঘড়ি সংগ্রহের ক্ষেত্রে তার জন্য এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।"
অনুবাদ: জেনিফার এহসান