প্রজেক্ট নিম্বাস কী? কেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছেন গুগলের কর্মীরা?
ইসরায়েলি সরকারের সাথে করা ১.২ বিলিয়ন ডলারের প্রোজেক্ট নিম্বাস চুক্তির বিরোধিতা করে গত সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার নিউ ইয়র্ক সিটি এবং সিয়াটলের অফিসে বিক্ষোভ করেছেন গুগলের কর্মীরা।
প্রজেক্ট নিম্বাস নামে পরিচিত এ যৌথ চুক্তিটি ২০২১ সালে স্বাক্ষরিত হয়। গুগল এবং অ্যামাজনের মধ্যে করা এ যৌথ চুক্তির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠান দুটি ইসরায়েলি সরকার ও দেশটির সেনাবাহিনীকে ক্লাউড কম্পিউটিং অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অন্যান্য প্রযুক্তি পরিষেবা প্রদান করছে। গাজায় চলমান যুদ্ধের মধ্যে নিন্দার সম্মুখীন হয়েছে চুক্তিটি।
গাজায় চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত অক্টোবরে শুরু হওয়া ইসরায়েলের সামরিক হামলায় গাজার বিভিন্ন শহরের অসংখ্য অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। হামাসকে ধ্বংস করার অজুহাত দেখিয়ে এ হামলাকে যৌক্তিক দাবি করে আসছে ইসরায়েল।
কেন গুগলের কর্মীরা প্রোজেক্ট নিম্বাসের বিরোধিতা করছেন?
গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেল-এ 'নো টেক ফর আপার্টহাইট' (বর্ণবাদের জন্য প্রযুক্তি নয়) নামে একটি গ্রুপের নেতৃত্বে এ বিক্ষোভ হয়েছে। তারা ২০২১ সাল থেকে প্রজেক্ট নিম্বাসের বিরুদ্ধে গুগল কর্মীদের সংগঠিত করে আসছে। এই কর্মীরা ইসরায়েলের সাথে তাদের প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে কারণ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আছে।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা তাদের কাজ কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সে সম্পর্কে স্বচ্ছতার দাবি জানিয়েছেন। তাদের কাজ ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। অ্যামাজন এবং মেটার কর্মীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের যুদ্ধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে মালিকপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।
গুগলের স্টাফ সফটওয়্যার প্রকৌশলী টিনা ভাচভস্কি পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেছেন, "যখন আপনি জানেন যে আপনার কোম্পানি ইসরায়েল সরকারকে এমন পণ্য সরবরাহ করছে যা ফিলিস্তিনে নৃশংসতা চালাতে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন কাজ করার জন্য আগ্রহ ও উৎসাহ থাকাটা অসম্ভব।" তার বক্তব্যটি নো টেক ফর আপার্টহাইট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক নিউজ আউটলেট দ্য ইন্টারসেপ্টের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল যাতে বলা হয়, গুগল প্রোজেক্ট নিম্বাসের অংশ হিসেবে ইসরায়েলকে উন্নত এআই প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। এই প্রযুক্তিগুলো ফেসিয়াল রিকগনিশন (চেহারা শনাক্ত করা) এবং অবজেক্ট ট্র্যাকিংয়ের (কোন বস্তু শনাক্তকরণ) মতো কাজের জন্য তথ্য সরবরাহ করতে পারে।
অ্যাক্টিভিস্ট এবং শিক্ষাবিদরা ফিলিস্তিনি লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের এআই ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আইনি বিশেষজ্ঞরাও বলেছে, যুদ্ধ এআই এর ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করে।
একটি বিবৃতিতে গুগল জানিয়েছে, প্রোজেক্ট নিম্বাস চুক্তি অস্ত্র ও গোয়েন্দা পরিষেবা অথবা সামরিক কাজের সাথে সম্পর্কিত নয়। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এটি ইসরাইল সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে কাজ করছে।
বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়েছে গুগল
মঙ্গলবার গুগল 'প্রতিষ্ঠানের আচরণবিধি' লঙ্ঘন এবং 'হয়রানি, বৈষম্য এবং প্রতিশোধ' নীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কমপক্ষে ২৮ জন কর্মীকে বরখাস্ত করেছে। এছাড়া নিউইয়র্ক এবং সানিভেলের অফিস থেকে বিক্ষোভ করায় কমপক্ষে নয়জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই গত সপ্তাহে একটি ব্লগ পোস্টে এ নিয়ে সতর্কতা জারি করেছেন। গুগলের নিউইয়র্ক অফিসে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া গুগল সফটওয়্যার প্রকৌশলী মোহাম্মদ খাতামি বলেছেন, কর্মীরা এ সতর্কতায় নিরুৎসাহিত হননি।
নো টেক ফর আপার্টহাইটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুগল সম্প্রতি আরও ২০ জনের বেশি বিক্ষোভকারীকে বরখাস্ত করেছে। গ্রুপটির মুখপাত্র জেন চুং গুগলের পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন, গুগলের লক্ষ্য ভিন্নমতকে চুপ করানো এবং কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা।
কয়েকজন প্রতিষ্ঠানের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করা এবং মুখোশ পরে ও স্টাফ ব্যাজ না পরে পরিচয় গোপন করার চেষ্টা চালানোর বিষয়টি তদন্তের পরে নিশ্চিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে গুগল। তবে কতজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে তা নিয়ে গুগল কোন সঠিক সংখ্যা উল্লেখ করেনি।
সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করা নিয়ে প্রযুক্তি কর্মীদের বিরোধিতার ইতিহাস
গত বছরের অক্টোবরে অ্যামাজন এবং গুগলের কর্মীদের বেনামে পাঠানো একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল মার্কিন সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে। চিঠিতে প্রজেক্ট নিম্বাস নিয়ে কর্মীরা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তারা কোম্পানির নেতাদের এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাথে চুক্তি শেষ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এর আগেও একই ধরনের প্রতিবাদ হয়েছিল। ২০১৮ সালে গুগলের কর্মীরা প্রজেক্ট মাভেনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। প্রজেক্ট মাভেনের অংশ হিসেবে গুগল ২০১৭ সালে পেন্টাগনকে (মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর) ড্রোন নজরদারির জন্য তোলা ছবি বিশ্লেষণ করতে এআই সহায়তা দিয়েছিল।
মার্চ মাসে একটি সম্মেলনে গুগলের কর্মচারী এডি হ্যাটফিল্ড ক্ষতিকারক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত প্রযুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। গুগল ইসরায়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বারাক রেগেভকে বাধা দেওয়ার অভিগোগে প্রতিষ্ঠানটি তাকে বরখাস্ত করেছিল। তার বহিষ্কারের পরেই প্রজেক্ট নিম্বাসের বিরুদ্ধে আরো প্রতিবাদের জন্ম হয়েছিল।
গত বছরের ডিসেম্বরে এক হাজার সাতশ অ্যামাজন কর্মী প্রজেক্ট নিম্বাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সিইও অ্যান্ডি জ্যাসির কাছে একটি দরখাস্ত দিয়েছিলেন। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন, ইসরায়েলি পাবলিক সেক্টরে ক্লাউড পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে অ্যামাজন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এআই এবং নজরদারি ক্ষমতাকে শক্তিশালী করছে যা ফিলিস্তিনিদের দমন করতে ও গাজার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে ব্যবহৃত হয়েছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়