আরব সামরিক বাহিনীগুলোর এত দুরবস্থা কেন?
গত এপ্রিলে ইসরায়েলে প্রথমবারের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এই আক্রমণ ঠেকাতে আরব দেশগুলোর আকাশ প্রতিরক্ষা সেনারা সহায়তা করে পশ্চিমা বিশ্বের প্রশংসা কুড়ায়। আর ধিক্কার কুড়ায় গাজায় চলমান গণহত্যায় ক্ষুদ্ধ মুসলিম বিশ্বের জনসাধারণের।
তবে আরব দেশগুলো (জর্ডান এবং উপসাগরীয় আরব দেশগুলো) তাদের সামরিক দক্ষতার পরিচয় কোনোদিনই দিতে পারেনি। যুদ্ধে বীরত্ব ও দক্ষতার জন্য আধুনিক যুগে তাদের সামরিক বাহিনীর নামডাকও তেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আরব জাতীয়তাবাদের যুগে যখন জর্ডান ও উপসাগরীয় আরবরা ইসরায়েল-বিরোধী যুদ্ধে নামকাওয়াস্তে যোগ দিয়েছে – তখনও তারা বারবার পরাজয় বরণ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র সামরিকভাবে দক্ষ সেনাবাহিনী ছিল সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মিত্র জোটে থাকা আরব সেনাবাহিনীগুলো তাদের অদক্ষতারই পরিচয় দেয়।
উপসাগরীয় যুদ্ধের মাধ্যমেই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুদ্ধ কৌশলের নবযুগের সূচনা করে আমেরিকা। রাডারকে বহুলাংশে ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিলথ প্রযুক্তির বোমারু বিমান দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় ইরাকের সোভিয়েত প্রযুক্তির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এরপর আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে মিত্র জোট। ইরাকের সেনাবাহিনী প্রচণ্ড বোমা হামলায় পর্যদুস্ত হতে থাকে।
উপসাগরীয় যুদ্ধে মিশর দুটি সাঁজোয়া ডিভিশন পাঠিয়েছিল। কিন্তু, সামান্য ইরাকি প্রতিরোধের মুখেই যখন তাদের হিমশিম অবস্থা– তখন তাদের মূল যুদ্ধ থেকে সাইডলাইনে পাঠাতে বাধ্য হয় জোটের নেতৃত্বদানকারী আমেরিকা। এই যুদ্ধে সৌদি আরবসহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ সীমিত সংখ্যক সেনা পাঠিয়েছিল।
এ ছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা সত্ত্বেও ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বধীন জোট প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
অর্থ বা আধুনিক সামরিক সরঞ্জামের অভাব তাদের মূল সমস্যা নয়। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)-ভুক্ত ছয়টি আরব দেশ এবং মিশর ও জর্ডানের মোট সামরিক ব্যয় বছরে ১২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি (সে তুলনায়, ২০২৩ সালে ন্যাটো জোটের ইউরোপীয় সদস্যদের মোট ব্যয় ছিল ৩৮০ বিলিয়ন ডলার)। এসব আরব দেশের মোট সেনাসংখ্যা ৯ লাখ ৪৪ হাজার। রয়েছে ৪ হাজার ৮০০ ট্যাংক এবং এক হাজার যুদ্ধবিমান।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ সামরিক সহায়তা পায় মিশর ও জর্ডান। উভয়ের জন্য বছরে যার পরিমাণ ১.৭ বিলিয়ন ডলার। কায়রোতে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে পল কলিন্সের মতে, এই অর্থের বেশিরভাগই নয়ছয় হচ্ছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রেয়াস ক্রেইগ বলেছেন, অনেক সময় আরব দেশগুলো আধুনিক ফাইটার জেটের মতো দামি অস্ত্রের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু, তাদের যে ধরনের অসমানুপাতিক হুমকির (সন্ত্রাসবাদী বা সশস্ত্র গোষ্ঠী) মোকাবিলা করতে হয় – সেজন্য এসব অস্ত্রের দরকার নেই।
তারপরেও ঢাকঢোল পিটিয়ে বিপুল অর্থ দিয়ে দামি দামি অস্ত্র কেনা হয় পশ্চিমা সরকারগুলোর নেকনজরে থাকতে। এ ধরনের ক্রয়ের আরেক উদ্দেশ্য তাদের পশ্চিমাদের কাছে নিজস্ব প্রভাব বাড়ানো । যেমন এফ-১৫, রাফায়েল ও টাইফুন যুদ্ধবিমান কিনে একইসাথে ওয়াশিংটন, প্যারিস ও লন্ডনের সুদৃষ্টি পেয়েছে কাতার।
যদিও এভাবে আধুনিক জঙ্গিবিমান ক্রয়, সেগুলোর অস্ত্রপাতি ও রক্ষণাবেক্ষণ মানেই বিপুল অর্থের শ্রাদ্ধ। গত এক দশকে সৌদি আরব যত অস্ত্র আমদানি করেছে, তার ৫৪ শতাংশই ছিল বিপুল দামের যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার। কিন্তু, বিমানবাহিনীর পেছনে সামরিক বাজেটের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢাললে, সেনা ও নৌবাহিনীর অন্যান্য শাখাগুলো বঞ্চিত হয়।
সমুদ্রপথে বাণিজ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে এসব দেশ। কিন্তু সে তুলনায়, নৌবাহিনীর উন্নয়নে সামান্যই মনোযোগ দিয়েছে। তাদের নৌবহর অপেক্ষাকৃত ছোট এবং মূলত উপকূলীয় প্রতিরক্ষার উপযোগী। সাগর দিয়ে আধুনিক প্রতিপক্ষের হামলা ঠেকানোর মতো আগাম সতর্কতা প্রদানকারী সেন্সর বা ইন্টারসেপ্টরও নেই। ফলে লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠীর আক্রমণ ঠেকাতেও এসব দেশের নৌবাহিনী সামান্য ভূমিকা রাখতে পেরেছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের বিশেষজ্ঞ ডেভিড রবার্টস বলেন, বহু দশক ধরে এসব আরব শাসকদের নৌবাণিজ্যকে সুরক্ষা দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তারা নৌশক্তিতে বিনিয়োগের কোনো তাগিদ বোধ করেনি। নৌশক্তিতে যারা এখন বিনিয়োগ শুরু করেছে – তারাও ব্যাপক জনবল সংকটে পড়েছে। যেমন ইতালির কাছে ছয়টি নতুন যুদ্ধজাহাজের অর্ডার দিয়েছে ইতালি, কিন্তু এগুলো পরিচালনার জন্য আরো ৬৬০ জন নতুন নাবিক দরকার, যা দেশটির নৌবাহিনীর বর্তমান সদস্য সংখ্যার শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ।
সামরিক দুর্বলতার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, আরব সেনানায়করা তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণ করেন।
অ্যান্ড্রেয়াস ক্রেইগ বলেন, সর্বস্তরের সেনারা যেন যুদ্ধের প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেই অধিকার যেন ক্ষুণ্ণ না হয়– পশ্চিমা জেনারেলরা সেদিকে খেয়াল রাখেন। অন্যদিকে, আরব জেনারেলরা এই স্বাধীনতা দিতে একেবারেই নারাজ। তারা নিজেদের ঘাড় বাঁচাতে, বা শাসকদের তুষ্ট করে পদোন্নতির জন্য জাতীয় প্রতিরক্ষা স্বার্থ জলাঞ্জলী দিতে দ্বিধা করেন না।
ফলে তাদের সামরিক মহড়াতেও বাস্তব হুমকি মোকাবিলার চর্চা দেখা যায় না। ধনী অনেক আরব দেশে সামরিক বাহিনীকে শাসকদের দেহরক্ষীর ভূমিকায় রাখা হয়েছে। যেমন সৌদি রাজপরিবারকে নিরাপত্তা দানকারী সৌদি ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার। মিশরে আবার সামরিক বাহিনী হলো সর্বেসর্বা, তারা পর্যটন থেকে শুরু করে নির্মাণ খাত পর্যন্ত অর্থনীতির প্রায় সকল খাতে জড়িয়ে পড়েছে। এতে তাদের পেশাদারিত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছে, দুর্নীতি জেনারেলদের মজ্জাগত স্বভাবে রূপ নিয়েছে।
অনেকে আশা করছেন, আরব দেশগুলো গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে পারে। তবে এনিয়ে বিশেষজ্ঞরাও সন্দিহান। তারা মনে করছেন, অত্যাধুনিক লড়াইয়ের অপারেশনাল সক্ষমতা নেই আরব সেনাদের। তাছাড়া, এক দেশের সেনাদের সাথে অন্য দেশের সেনাদের সমন্বয় করাও হবে কঠিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব দেখা যায়। ফলে একে অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কার্যক্রম পরিচালনায় তারা হিমশিম খায়।
মার্কিন চিন্তক সংস্থা – আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ এবং আরব সেনাবাহিনীগুলোর বাজে পারদর্শিতা নিয়ে একটি বইয়ের লেখক কেনেথ পলোক। তিনি বলেন, "তারা খুবই সন্দিহান, একে-অন্যকে তারা বিশ্বাসও করে না।"
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে জিসিসি জোটের দেশগুলোর একটি যৌথ সামরিক কাঠামো গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে এর মাধ্যমে বড় প্রতিবেশীরা অপেক্ষাকৃত ছোট সদস্য দেশকে নিয়ন্ত্রণ করবে এই আশঙ্কাও দেখা দেয়। ফলে এটি আর বেশিদূর এগোয়নি।
তাছাড়া, পশ্চিমাদের বংশবদ অধিকাংশ আরব শাসকের কাছে এই অঞ্চলের প্রতি আমেরিকার নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিশ্চিত করাটা যত গুরুত্বপূর্ণ – আঞ্চলিক একটি বহুপাক্ষিক সামরিক জোট গঠন ততোটা নয়। আমেরিকার সমর্থন ছাড়া অন্য দেশের সাথে যুদ্ধ লড়ার পরিকল্পনা করার সাহসও নেই।
উপসাগরীয় দেশগুলো আমেরিকার গোয়েন্দা তথ্য, নজরদারি ও আগাম সতর্কতার ওপর নির্ভর করে। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত আমেরিকার কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার ও রিফুয়েলিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর নির্ভর করে তাদের যুদ্ধবিমান। ঠিক একারণেই আমেরিকার সাথে একটি বিস্তৃত নিরাপত্তা চুক্তি করতে উঠেপড়ে লেগেছে সৌদি আরব।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামরিক দক্ষতার পরিচয়ও পাওয়া যায়। যেমন জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যোগ্য ও পেশাদার স্পেশাল ফোর্স ও পাইলট রয়েছে। ২০১৫ সালের ইয়েমেনের আদেন বন্দর নগরীতে সমুদ্রপথে এক উভচর আক্রমণ করে আমিরাতের স্পেশাল ফোর্স, পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা এসময় তাদের দক্ষতার প্রশংসা করেছিলেন। জর্ডান নিয়মিতভাবে গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলছে, গাজার মতো জনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর এই ধরনের মিশন পরিচালনা সত্যিই একটি কঠিন কাজ। তবে বিশেষায়িত এসব দক্ষ জনবল প্রায় সময়ে আমদানিও করা হয়, যেমন আমিরাতের প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড ও বিশেষ বাহিনীতে বহু বিদেশি উপদেষ্টাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের অধিকাংশই আবার পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা, আর বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির নাগরিকত্ব নেওয়া সাবেক একজন অস্ট্রেলিয়ান জেনারেল।
আরব বাহিনীগুলোর মধ্যে সামান্য পরিমাণে হলেও কিছুটা সহযোগিতা লক্ষ করা যায়। যেমন ইসরায়েলে ইরানের আক্রমণ ঠেকানোর পুরোভাগে আমেরিকা নেতৃত্ব দিলেও – আরব বাহিনীগুলোর মধ্যে ব্যাপক সহায়তা ছাড়া এটি করা অসম্ভব হতো বলে মন্তব্য করেন পল কলিন্স।
২০১৯ সালে সৌদির একটি তেল শোধনাগারে ড্রোন হামলা চালায় হুথিরা। খুব সম্ভবত এটি ইরানই করেছে। এরপর থেকেই উপসাগরীয় ও অন্য আরব দেশগুলো তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সমন্বিত করতে শুরু করে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এখন ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়।
২০২২ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে একটি আঞ্চলিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জোটে ইসরায়েলের সাথে যোগও দেয় অজ্ঞাত কিছু আরব দেশ। এই জোটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পরস্পরের রাডার শনাক্তকরণ ব্যবস্থাকে একসাথে কার্যকর রাখা।
তবে আরব সামরিক বাহিনীগুলো নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করার বিষয়ে বিষেশজ্ঞরা কিছুটা সংযত মনোভাব দেখান। কেনেথ পলোক বলেন, "আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয় ঠেকাতে কারিগরিভাবে কোনো বাধা নেই। পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করছে রাজনীতির ওপর।" অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে বড় ধরনের সামরিক সংস্কারের চেষ্টা দেখা যাবে। জ্বালানি রুপান্তর নিয়েও এখন বৈশ্বিক ঐক্যমত্য দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোও তাদের অর্থনীতি ও সমাজকে ঢেলে সাজাতে চায়। এজন্য শুধুমাত্র প্রচলিত সামরিক প্ল্যাটফর্মের বাইরে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা কেন্দ্রসহ সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে। সরকারগুলো আশা করছে, সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে বিপুল বিনিয়োগ বেসরকারি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এসবের কোনোটাই তাদের সামরিক খ্যাতি বা নামজশ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।
অনুবাদ: নূর মাজিদ