১০ জন ইউরোপীয়র ৭ জনই মনে করেন তাদের দেশ অনেক বেশি অভিবাসী গ্রহণ করেছে: জরিপ
ইউরোপের প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে সাতজনই মনে করেন, তাদের দেশ অনেক বেশি সংখ্যক অভিবাসীকে গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি একটি জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপের তথ্যমতে, উত্তরদাতাদের ৭১ শতাংশ মনে করেন, তাদের দেশ অনেক বেশি সংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ করেছে। ৮৫ শতাংশ মনে করেন অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আর গ্রীসের ৯০ শতাংশ মানুষেরই বিশ্বাস- তাদের দেশ অনেক বেশি সংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ করেছে।
ইউরোপের যেসব দেশের বেশিরভাগ মানুষ অভিবাসনকে একটি সমস্যা বলে মনে করেন, সেসব দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বুলগেরিয়া। দেশটির ৭৪ শতাংশ মানুষের ধারণা এমন। এরপরে রয়েছে চেক প্রজাতন্ত্র (৭৩ শতাংশ), হাঙ্গেরি (৬৮ শতাংশ) ও সাইপ্রাস (৬৮ শতাংশ)।
তবে ইতালির অবস্থান এক্ষেত্রে মোটামুটি ব্যতিক্রমই বলা চলে। কারণ গত বছর ইতালিতে অবৈধভাবে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী প্রবেশ করলেও দেশটির মাত্র ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতা এটিকে সমস্যা বলে মনে করেন। আর মাত্র ১৪ শতাংশ এটিকে প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন।
উল্লেখ্য, গত বছর এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৫২ জন অবৈধ অভিবাসী ইতালিতে প্রবেশ করে।
ইতালির পর গত বছর সবচেয়ে বেশি অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ করেছে গ্রীসে। এরপরের অবস্থানে রয়েছে স্পেন। এই দুই দেশেরই মাত্র ১১ শতাংশ উত্তরদাতা এটিকে বড় একটি উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করেন। তবে পুরো ইউরোপ হিসাব করলে মহাদেশটির গড়ে ১৭ শতাংশ মানুষ এটিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রে গত ২৭ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত অনলাইনে এ জরিপ চালানো হয়। জরিপে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ২২ হাজার ৭২৬ জন মানুষের মতামত নেওয়া হয়।
জরিপটি পরিচালনা করেছে গবেষণা ও পরামর্শক সংস্থা বিভিএ এক্সসাইট। স্প্যানিশ সংবাদপত্র এল পাইসের পাশাপাশি আরও কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
আগামী ৬ থেকে ৯ জুন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের মাসখানেক আগে এ জরিপের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়রা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানালেন। এ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি রাষ্ট্রের ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ভোট দেওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে অভিবাসনের পর ৪১ শতাংশ ইউরোপীয়র কাছে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো স্বাস্থ্য। আর ৩৮ শতাংশের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ২৪ শতাংশের কাছে পরিবেশ ও মুদ্রাস্ফীতি।
তবে দেশভেদে উত্তরদাতাদের উদ্বেগের বিষয়গুলোর ভিন্নতা দেখা গেছে। যেমন- ফ্রান্সের মানুষের কাছে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো ক্রয় ক্ষমতা। পোল্যান্ডের জনগণ নিরাপত্তা নিয়ে এবং আইরিশদের উদ্বিগ্ন আবাসন নিয়ে। অন্যদিকে বেকারত্ব নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন স্প্যানিশরা।
এদিকে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী, যদিও ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন যে ইইউয়ের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে এবং ৬৩ শতাংশ উত্তরদাতাও নিজেদের দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এমনটা ধারণা করেন।
উত্তরদাতাদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশের বিশ্বাস- ইইউয়ের সিদ্ধান্ত তাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে পর্তুগালই একমাত্র দেশ, যেটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এমনটা মনে করেন। এর হার ৫১ শতাংশ।
আর স্পেন, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও রোমানিয়ায় ৪৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ও চেক প্রজাতন্ত্রে ২১ শতাংশ, হাঙ্গেরিতে ২৪ শতাংশ এবং নেদারল্যান্ডসে ২৬ শতাংশ মানুষের বিশ্বাস- তাদের জীবনে ইইউয়ের সিদ্ধান্তের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
ইউরোপের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ তাদের জাতীয়তার চাইতে নিজেদের ইউরোপীয় ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন। তবে বেশিরভাগ ইউরোপীয়ই নিজেদের জাতীয়তাকে প্রাধান্য দেন।
সম্প্রতি ইইউতে যোগ দেওয়া বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের নাগরিকরা স্বীকার করেন যে যখন তারা ভোট দেন, তখন তারা ইউরোপীয়র চেয়ে নিজেদের জাতীয় প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেন। এর হার রোমানিয়ায় ৮২ শতাংশ, বুলগেরিয়ায় ৮১ শতাংশ এবং গ্রীস ও লাটভিয়ায় ৭৯ শতাংশ।
তবে ইইউভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগই সাধারণ ইউরোপীয় নীতিগুলোকে শক্তিশালী হিসেবে দেখতে চায়। বিশেষ করে ৭২ শতাংশ রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা এবং ৭০ শতাংশ রাষ্ট্র অভিবাসন নীতিকে শক্তিশালী হিসেবে দেখতে চায়।
জরিপ পর্যালোচনাকারীরা মনে করেন, জরিপটি ইউরোপের এমন একটি চিত্র তুলে ধরেছে, যেখানে একটি পক্ষ (যেমন- এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ড) বিশ্ব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং আরেকটি পক্ষ (যেমন- ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম ও পর্তুগাল) উদ্বিগ্ন ক্রয় ক্ষমতা নিয়ে।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মাত্র ১৪ শতাংশ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের সময়ের তুলনায় এখন নিজেদের আরও বেশি ইউরোপীয় বলে মনে করেন। আর ১৫ শতাংশ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিজেদের আরও কম ইউরোপীয় বলে ভাবেন।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়।
আসন্ন যুদ্ধের আশঙ্কা
জরিপে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ ইউরোপীয় রাশিয়ার সাথে একটি আসন্ন যুদ্ধের আশঙ্কা করেন। ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার কাছাকাছি অবস্থানের কারণে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও রোমানিয়ার মানুষদের এ আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
ইউরোপের মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ইউরোপের পর্যাপ্ত সামরিক সংস্থান রয়েছে।
অন্যদিকে ৬১ শতাংশ মনে করেন, ইউক্রেনের প্রতি ইইউয়ের সমর্থন আরও জোরালো করা উচিত। আর ৬৩ শতাংশ মনে করেন, যুদ্ধবিরতি (রাশিয়া-ইউক্রেন) নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
সার্বিকভাবে ইউরোপের ৬৩ শতাংশ মানুষ ইউক্রেনের ইইউতে যোগদানের পক্ষে। তবে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনার পক্ষে মত দেওয়া দেশগুলো (হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়া ও বুলগেরিয়া) চায় না ইউক্রেন ইইউতে যোগদান করুক।
উদ্বেগ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও
জরিপে পরিবেশ নিয়েও ইউরোপীয়দের উদ্বেগের চিত্র উঠে এসেছে। ১৯ শতকে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে গত বছর (২০২৩ সাল) ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর।
৮২ শতাংশ ইউরোপীয় এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বলে মনে করেন এবং ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা (বিশেষ করে দক্ষিণ ইউরোপের মাল্টা, ইতালি, পর্তুগাল, সাইপ্রাস ও স্পেনের) বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউরোপীয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকার ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন।
যেমন- ৬০ শতাংশ ইউরোপীয় কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত এবং ৫৭ শতাংশ গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।
তবে ব্যক্তিগত আচরণ বা অভ্যাস পরিবর্তন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোর (যেমন ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমাতে কর বৃদ্ধি) সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন মাত্র ২১ শতাংশ ইউরোপীয়।
অর্থাৎ উত্তরদাতাদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত আচরণ পরিবর্তনের বিষয়ে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক