সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সুদীর্ঘ বিশ বছরের লি যুগের অবসান
দীর্ঘ বিশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং পদত্যাগ করেছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৫১ বছর বয়সী লরেন্স ওং গতকাল বুধবার (১৫ মে) দায়িত্ব নিয়েছেন।
১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মাত্র চারজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে সিঙ্গাপুর। চারজনই পিপলস অ্যাকশন পার্টির (পিএপি) প্রতিনিধি ছিলেন। সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলে লি সিয়েন এর বাবা লি কুয়ান ইউ যিনি ২৫ বছর ধরে দেশটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাকে আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লি পরিবারের প্রভাব থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নতুনভাবে বিকশিত হবে। কিন্তু লি সিয়েন লুং এখনো জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় থাকবেন। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ সাক্ষাৎকারে সিঙ্গাপু্রের জনগণকে তাদের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
তার বাবা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই ১৯৮৪ সালে লি রাজনীতিতে যুক্ত হন। দেশটির দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক তং-এর ক্ষমতকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৪ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
রাজনীতিতে তার প্রথম বছরগুলোতে তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন। সমালোচকরা তার পরিবারের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও একটি রাজনৈতিক রাজবংশ গঠনের অভিযোগ এনেছিলেন যা তিনি বারবার অস্বীকার করে এসেছেন। কিন্তু দুই দশক ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি তার কাজ দিয়ে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন।
তার নেতৃত্বেই সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। এটি বিশ্বব্যাপী একটি প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র ও জনপ্রিয় ভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত দুই দশকে জনপ্রতি জিডিপি দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মন্দা, বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট এবং কোভিড-১৯ মহামারি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে সিঙ্গাপুরকে সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য তিনি এবং তার প্রশাসনের যথেষ্ট অবদান ছিল।
ভূ-রাজনীতিতেও যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন লি সিয়েন লুং। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার মধ্যেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের নিয়ে করা জরিপের শীর্ষে অবস্থান করার পাশাপাশি নির্বাচনের সময় তার নির্বাচনী এলাকায় ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন।
কিন্তু তার বিপুল পরিমাণ জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তার প্রশাসনের অভিবাসন নীতি নিয়ে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্য ও আয়ের অসমতা বেড়ে যাওয়ায় তিনি ও তার প্রশাসন সমালোচনার শিকার হয়েছেন। তারই নেতৃত্বে ২০১১ ও ২০২০ সালে পিপলস অ্যাকশন পার্টি দেশটির ইতিহাসের সর্বনিম্ন ভোট পেয়েছিল।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, লি'র সরকার পাবলিক হাউজিং নিয়ে সিঙ্গাপুরের একটি জটিল সমস্যাকে পুরোপুরি সমাধান করতে পারেনি। সিঙ্গাপুরের অধিকাংশ মানুষ এসব বাড়িতে বসবাস করেন। সরকারের কাছ থেকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেওয়া এই ফ্ল্যাটগুলো সময়ের সাথে সাথে অবমূল্যায়িত হতে পারে যা মানুষের সঞ্চয়কে প্রভাবিত করতে পারে।
লি'র সরকার এ উদ্বেগের কথা স্বীকার করেছিলেন এবং সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে কঠোর অভিবাসন নিয়ম, নতুন আবাসন প্রকল্প ও বর্ণবাদ বিরোধী আইনের সংস্কার।
২০১৬ সালে লি'র বাবা লি কুয়ান ইয়ু-এর বাড়ি নিয়ে পারিবারিক কলহের সূত্রপাত হয়। লি তার ভাইবোনদের সাথে একটি প্রকাশ্য বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে তাদের পিতার উত্তরাধিকারকে পুঁজি করা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ আনা হয়। লি অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, তার সন্তানরা রাজনীতিতে আগ্রহী নয়।
লি এখন ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন প্রাক্তন অর্থনীতিবিদ ও বেসামরিক কর্মচারী লরেন্স ওং এর কাছে। ওং এক পর্যায়ে লি'র প্রধান ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করেছিলেন।
সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি দেশটির ঐতিহ্যবাহী লি পরিবারের বাইরে থেকে ক্ষমতায় এসেছেন। এর আগে লি পরিবারের বাইরে থেকে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে গোহ চোক তং ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বুধবার দায়িত্ব নেওয়ার পর ওং সম্পূর্ণ নতুন নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা পূর্ববর্তী প্রজন্মের থেকে আলাদা হবে। তিনি মার্কিন-চীন সম্পর্ক নিয়ে সিঙ্গাপুরের বর্তমান নীতি টিকিয়ে রাখার পক্ষে এবং জোর দিয়ে বলেছেন, সরকার 'সিঙ্গাপুরপন্থী' থাকবে এবং দুই পরাশক্তির মধ্যে কোন পক্ষ নিবে না।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়