অভিবাসী মর্যাদা হারানোর ঝুঁকি নিয়েই গাজা বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা
পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে আন্দোলন করে আসছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সহ ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধ করা, ইসরায়েলকে আর্থিক সুবিধা দেয়া বন্ধ করা এবং ইসরায়েলের সাথে আর্থিক সম্পর্ক আছে এমন প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিনিয়োগ বন্ধ করার দাবিতে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী আন্দোলন করে আসছেন। পুলিশি বাঁধা, গ্রেপ্তার, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর অবস্থান সহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেই তারা ক্যাম্পাসে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৯ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু মাহমুদ খলিলের জন্য এ আন্দোলনে যুক্ত হওয়াটা সহজ ছিল না। সিরিয়ায় বেড়ে ওঠা খলিল শুরুতে আন্দোলনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। এফ-১ শিক্ষার্থী ভিসায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা খলিলকে এখানে থাকার জন্য নিজের ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে যেভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে, আন্দোলনে সক্রিয় থাকা খলিলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
খলিলের মতোই কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার, ভিসা বাতিল হওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য শাস্তির ভয় নিয়েই এ আন্দোলনে যুক্ত হতে হয়েছে। অনেককেই ইতোমধ্যে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ৩০ এপ্রিল খলিলকে প্রশাসন থেকে ই-মেইল করে বহিষ্কার করার বিষয়টি জানানো হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাতে ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অপব্যবহারের সাথে জড়িত গোষ্ঠীগুলিকে চাপ দিতে কাজ করা 'কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আপার্টহাইট ডাইভেস্ট' নামের শিক্ষার্থী সংঘের প্রধান মধ্যস্ততাকারী খলিল বহিষ্কারের ঘটনায় হতবাক হয়েছিলেন।
খলিল বলেছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন যাতে তার কর্মকাণ্ডের জন্য কোন সমস্যার মুখোমুখি না হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের সাথে তার কথোপকথনের উপর ভিত্তি করে তিনি ভেবেছিলেন, তার শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কিন্তু খলিলকে অবাক করে দিয়ে একদিন পরেই বহিষ্কার তুলে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেকটি ই-মেইল পাঠিয়ে তাকে জানানো হয়, "কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি পাবলিক সেফটির সাথে আমাদের রেকর্ড ও প্রমাণ পর্যালোচনা করার পর আপনার অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।" বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে ফোন দিয়ে খলিলের কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন আইনজীবীরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, সাময়িক স্থগিতাদেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার জন্য শিক্ষা ভিসার ওপর নির্ভরশীল ছাত্রদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
সিইউএনওয়াই স্কুল অব ল-এর 'ক্রিয়েটিং ল এনফোর্সমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি' প্রকল্পের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নাজ আহমেদ আল জাজিরাকে বলেছেন, ভিসা নিয়ে পড়তে আসা কোন শিক্ষার্থী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীর তালিকা থেকে বাদ যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই সেটি হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগকে ২১ দিনের মধ্যে জানাতে হয়। এ বিভাগ অভিবাসন পরিষেবার তত্ত্বাবধান করে।
নাজ আহমদ বলেছেন, কোন শিক্ষার্থী এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দেয়া উচিত কারণ এতে অভিবাসী মর্যাদা হারানোর ঝুঁকি থেকে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত এমন কর্মকর্তা থাকেন যারা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অবস্থা তদারকি করেন এবং নির্দেশনা প্রদান করে। এমনকি যারা দেশটির নাগরিকত্ব পাননি তারা মার্কিন 'প্যাট্রিয়ট আইন' এর অধীনে যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ বা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে পারেন।
প্যাট্রিয়ট আইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন কোন কাজ 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড' হিসেবে চিহ্নিত হবে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সরকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকলে যে কোনো ব্যক্তির অভিবাসন সীমিত করতে পারবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলোতে চলমান বিক্ষোভ ক্যাম্পাস বিক্ষোভের জন্য অনেক মার্কিন কর্মকর্তা ধারণা করছেন এটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সূচনা করতে পারে। ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘস্থায়ী জোটের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির সমালোচনা করা বিশেষভাবে সংবেদনশীল ধরা হয়।
যদিও বেশিরভাগ ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলছে, মার্কিন রাজনীতিবিদরা সহিংসতা এবং ইহুদি-বিরোধী অনুভূতি ছড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। রিপাবলিকান প্রতিনিধি অ্যান্ডি ওগলস সম্প্রতি 'স্টাডি অ্যাব্রড অ্যাক্ট' প্রবর্তন করেছেন যেটির লক্ষ্য 'বেআইনি বিক্ষোভে জড়িত থাকলে শিক্ষার্থী ভিসা প্রত্যাহার করা'।
আন্দোলনে জড়িত থাকা কয়েকজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, নতুন এ আইনের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে দূরে থাকছে।
বিদেশি শিক্ষার্থীরা সরাসরি অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বা পুলিশের সাথে সংঘাতে জড়ানোর পরিবর্তে জরুরি পণ্য সরবরাহ ও অন্যান্য পরিষেবা প্রদান করে আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে।
২৯ এপ্রিল কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠকেরা সম্ভাব্য স্থগিতাদেশ এড়াতে ভিসা নিয়ে পড়তে আসা সহপাঠীদের সতর্ক করে দেয়ার পাশাপাশি অবস্থান ক্যাম্প থেকে চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং করেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তা দেখে আকৃষ্ট হয়েই তিনি এখানে ভর্তি হয়েছেন। অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বিক্ষোভ হয়েছিল মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
কিন্তু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ অথবা নজরদারিতে থাকার সম্ভাবনা থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা এখন আগের থেকে আরো সতর্ক অবস্থানে থাকছেন। বিক্ষোভ থামাতে পুলিশের দমন-পীড়নও কিছু শিক্ষার্থীকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে বাধা দিচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনে যোগ দিলেও বহিষ্কারের ভয়ে সরে আসছেন। গ্রেপ্তার হলে তার পরিণতি কী হবে এবং কীভাবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে— সেটি নিয়ে আন্দোলনকারী অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী উদ্বিগ্ন।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়