কাঙ্ক্ষিত ভোট পায়নি বিজেপি; কিছু ভোটার কেন মোদিকে না বলেছেন
'৪০০ পার' — নরেন্দ্র মোদি যখন এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা জোর গলায় বলেছিলেন, তখন খুব বেশি মানুষ তার কথা শুনে ভ্রুকুটি করে তাকাননি। আর কেন-ই-বা তাকাবেন, এক দশক আগে ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশটির রাজনৈতিক পটভূমিতে অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে।
মঙ্গলবার (৪ জুন) সকালে যখন ভোট গণনা শুরু হয়, তখন মোদি ও তার মিত্ররা বোধহয় নির্ভার ছিলেন এই ভেবে যে, এবারও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করবেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। মোদি আবারও সরকার গঠনের পথে আছেন বটে, তবে এবার আর তার আগের মতো সেই তেজ নেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতের নির্বাচন নিয়ে বিবিসি'র সাংবাদিকেরা কী ভাবছেন, এ নির্বাচন-পরবর্তী দৃশ্যপট কেমন হবে বলে মনে করেন তারা — পড়ুন এ লেখায়।
প্রচারণায় 'হিন্দু কার্ড' খেলা প্রশ্নের মুখে
ভারতের নির্বাচনে ধর্ম একটি প্রভাবক; এবারের নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্কিত স্থানে গত জানুয়ারিতে রাম মন্দির উদ্বোধন করেন মোদি। নির্বাচনে তার দল এর সুফল পাবে বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু বিজেপির নির্বাচনি ক্যাম্পেইন এতই একপেশে ছিল যে, অনেকের কাছে তা অপ্রত্যাশিত হিসেবে ঠেকেছে। দলের শীর্ষ নেতারা নির্বাচনের আগে অনেক আগ্রাসি মন্তব্য করেছেন।
খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদির অনেক মন্তব্যে বিশ্লেষকেরা মনে করেছিলেন, এসবের মাধ্যমে তিনি তার সংরক্ষণবাদী হিন্দুদের সমর্থনকে আরও পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু ফলাফল গণনার এ পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে, রাম মন্দিরের অযোধ্যায় বিজেপির প্রার্থী জিততে পারেননি। উপকারে আসেনি এ মন্দির।
তাই এখন ভোটার আকৃষ্টে হিন্দু কার্ড ব্যবহার নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত যখন মোদির এ পদক্ষেপ ঈপ্সিত ফলাফল তো দিতেই পারেনি, বরং বিজেপির বিরুদ্ধে মুসলিম সংখ্যালঘুদের যূথবদ্ধ করেছে।
- যোগিতা লিমায়ে—বিবিসি নিউজ, দিল্লি
'মোদি ব্র্যান্ডের ক্ষয় শুরু'
নরেন্দ্র মোদি ব্র্যান্ডিংয়ে ঈর্ষণীয় দক্ষ বলেই মানেন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা। তিনি আটপৌরে বিষয়কেও দারুণ চমকে পরিণত করতে পারেন।
২০১৭ সালেই সন্তোষ দেসাই নামক একজন প্রখ্যাত ভারতীয় ব্র্যান্ড কনসালট্যান্ট মোদির ঘটা করে কাজ করার বিষয়টির প্রশংসা করেছিলেন।
গত কয়েক বছরে মোদি নিজেকে একজন সাংস্কৃতিক আইকনেও পরিণত করতে সফল হয়েছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি নিজেকে একজন প্রভাবশালী নেতার ভূমিকায় নিয়ে গিয়েছেন। দুর্বল প্রতিপক্ষ ও প্রায় বৃহদাংশে বন্ধুত্বসুলভ আচরণকারী গণমাধ্যমও মোদিকে এ ব্র্যান্ড গড়তে সাহায্য করেছে।
কিন্তু মোদির এ জাদু এখন উবে যাওয়ার পথে। নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট, মোদি ব্র্যান্ড বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু। নরেন্দ্র মোদি এবারের আগে আর কখনো কোনো নির্বাচনে এত খারাপ করেননি, সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাননি।
- সৌতিক বিশ্বাস—বিবিসি নিউজ, দিল্লি
দক্ষিণ ভারতে মোদি বিরোধীরা ভোটারদের সঙ্গে বেশি যুক্ত
দক্ষিণ ভারতে মোদির ভোটের হার বাড়লেও সেখানে বিজেপি বড় প্রভাব রাখতে পারছে না। ২০২৯ সালে কর্ণাটকে বিজেপি একাই ২৫ আসনে জিতেছিল। কিন্তু এবার সেখানে কংগ্রেসের কাছে অন্তত ১০ আসন হারাচ্ছে এটি।
তেলেঙ্গানায় অতীতে জেতা চার আসন এবার দ্বিগুণ করতে পারে বিজেপি। অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইড়ুর নেতৃত্বাধীন তেলুগু দেসম পার্টির কল্যাণে বিজেপির জয় দু-একটি আসনে বাড়তে পারে।
তামিলনাড়ুতে আঞ্চলিক ডিএমকে দল ২০১৯ সালের মতোই একই আসনগুলোতে জিততে যাচ্ছে। তবে কেরালায় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটের কাছে হার মানতে হচ্ছে বিজেপিকে।
মোদ্দাকথা, বিজেপি বাদে অন্য দলগুলোর উন্নয়নকেন্দ্রিক কল্যাণ প্রকল্পসমূহ দক্ষিণের ভোটারদের সঙ্গে বেশি সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
- ইমরান কোরেশি—বিবিসি হিন্দি, বেঙ্গালুরু
এখন কী করবেন মোদি? তিনি কি 'দমে যাবেন'?
নরেন্দ্র মোদি গ্লোবাল সাউথের মূল কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যকার সেতুবন্ধন হিসেবে ভূমিকা রাখছেন তিনি।
বিশ্বমঞ্চে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাবের পেছনের কারণ ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে পাওয়া তার তুমুল জনপ্রিয়তা।
এ অভ্যন্তরীণ সমর্থন তাকে আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের কাছে স্থিতিশীলতা এবং নির্ভরযোগ্যতার প্রতীকে রূপ দিতে সহায়তা করেছে। তাদের আশ্বস্ত করেছে যে, তার নেতৃত্বে ভারত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি স্থিতিশীল এবং নির্ভরযোগ্য অংশীদার।
সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পাওয়ায় মোদি এখন জোট সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। তার পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিদলীয় সমর্থন থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে, এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাকে মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
নতুন এ পরিস্থিতে মোদি আগের চেয়ে কিছুটা খেই হারাতে পারেন। তিনি হয়তো পরামর্শমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি অবলম্বনে বাধ্য হবেন।
ভারত বৈদেশিক বিষয়ে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নীতি বজায় রেখেছে, যা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মিত্র বা বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা না করেই বৈশ্বিক ইস্যুতে মোদির দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতার পরিবর্তন হবে।
- বিকাশ পান্ডে—বিবিসি নিউজ, দিল্লি
জোট সরকার হবে মোদির জন্য 'লিটমাস টেস্ট'
এর আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে জোটের অংশীদারদের ভূমিকা ছিল সামান্য। এখন বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর থাকছে না, তাই মোদির তার জোট শরিকদের সমর্থন প্রয়োজন হবে।
নরেন্দ্র মোদি এককেন্দ্রিক সরকার চালাতে অভ্যস্ত হলেও এখন নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য মানিয়ে নিতে হবে তাকে।
একজন বিশ্লেষক উল্লেখ করে বলেন, জোটের শরিকদের উদ্বেগ ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে মোদিকে আরও সচেতন হতে হবে এবং এ বিষয়টি মোদির পক্ষে সহজ নয়।
জোট রাজনীতিতে ভারত নতুন নয়, তবে জোট সরকারগুলো প্রায়শই অস্থিরতার জন্ম দেয়। সুতরাং এটি নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি উভয়েরই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা পরীক্ষা করবে।
- নিতীন শ্রীবাস্তব—বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, দিল্লি