ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ পরিচালনায় সমর্থনের জন্য চীনকে মূল্য দিতে হবে: ন্যাটো প্রধান
ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, চীন যদি তাঁর অবস্থান না বদলায়– তাহলে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধকে সহায়তা দেওয়ার জন্য দেশটির পরিণামের সম্মুখীন হওয়া উচিত। যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করে– বেইজিং দু'দিক থেকেই ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে পারে না। খবর বিবিসির
আজ মঙ্গলবার (১৮ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন সফরে এসে স্টলটেনবার্গ বিবিসির কাছে এসব মন্তব্য করেন। এসময় তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়েও কথা বলেন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় রাশিয়া যখন কোনো ছাড় দিচ্ছে না তারমধ্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এর আগে গতকাল সোমবার (১৭ জুন) সুইজারল্যান্ডে শান্তি সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কিসহ ৩৭টি দেশের নেতারা যোগ দেন। ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ নিয়ে আলোচনা ছিল এ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য। তবে এর যৌথ ঘোষণাপত্রে যুদ্ধ নিয়ে ন্যাটো ও ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পেয়েছে।
সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে ৮০টির বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বাক্ষর করলেও– ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সৌদি আরবের মতো আঞ্চলিক শক্তির দেশগুলো ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকা ইউক্রেনের 'ভূখণ্ডের অখণ্ডতার' বিষয়ে একমত না হওয়ায় এতে স্বাক্ষর করেনি।
এই সম্মেলনকে অনর্থক সময়ের অপচয় বলেছে রাশিয়া। ইউক্রেন যদি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে– তাহলেই কেবল শান্তি আলোচনার জন্য রাজী হবে মস্কো– ক্রেমলিনের প্রতিক্রিয়ায় এমন আভাস ছিল বলে ব্যাখ্যা করেছে বিবিসি।
এই প্রেক্ষাপটে, চীনকেই দুষছেন ন্যাটো মহাসচিব। রাশিয়ার প্রতি চীনের সমর্থনের বিষয়ে ন্যাটো সদস্যরা কী করতে পারে– স্টলটেনবার্গকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, (চীনের ওপর) সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে 'আলোচনা হয়েছে'।
স্টলটেনবার্গ বলেন, 'মাইক্রো- ইলেকট্রনিক্স-সহ বহু ধরনের প্রযুক্তি শেয়ার করছে চীন। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও অস্ত্র নির্মাণে এসব অপরিহার্য, এবং সেগুলো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।"
তিনি আরো বলেন, "চীন যদি তার এই আচরণ না পাল্টায়, তাহলে একটা পর্যায়ে এসে দেশটিকে যেন অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হয়– সেটা আমাদের ভাবতে হবে।"
রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ায় গত মাসে চীন ও হংকংয়ে অবস্থিত অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে মস্কোর সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বেইজিং বলেছে, চীন (রাশিয়ার কাছে) প্রাণঘাতী সমরাস্ত্র বিক্রি করছে না এবং দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য পণ্যগুলো যথাযথ আইন ও বিধিবিধান মেনে রপ্তানি করে থাকে।
আজ মঙ্গলবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়া যাচ্ছেন। একইদিনে ওয়াশিংটনে গেলেন ন্যাটো মহাসচিব। এর আগে গত মাসে দুই দিনের এক সফরে চীনেও যান পুতিন।
পুতিন এর আগে বলেছিলেন, পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসছে, এবং তিনি সমমনা (পশ্চিমা) নেতাদের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়তে কাজ করেছেন।
এবিষয়ে স্টলটেনবার্গ বলেন, "রাশিয়া এখন কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।" উদাহরণ হিসেবে, ইরান, চীন ও উত্তর কোরিয়ার কথা বলেন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়াকে ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া দিয়েছে বিপুল পরিমাণ কামানের গোলা। বিনিময়ে রাশিয়া পিয়ংইয়ংয়ের ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু কর্মসূচিতে আরো উন্নত প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে বলে ধারণা পশ্চিমা গোয়েন্দাদের।
স্টলটেনবার্গ মন্তব্য করেন, "এভাবে উ. কোরিয়া রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধ চালাতে সহায়তা দিচ্ছে।"
ন্যাটো মহাসচিবের আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠকের কথা রয়েছে। এর আগে তিনি জানান, ন্যাটোর আরো ২০টি সদস্য দেশ চলতি বছরে তাদের জিডিপির ২ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চলেছে। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে ব্যয়ের এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর আগে কোনবছরই এত বেশি ন্যাটো সদস্য এটি পূরণ করতে পারেনি। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর জন্য চাপের মুখে রয়েছে। বিশেষত এই চাপ এসেছে ন্যাটোর সবচেয়ে বড় শক্তি আমেরিকার কাছ থেকে।
স্টলটেনবার্গ বলেন, "(এই অগ্রগতি) ইউরোপের জন্য ভালো, আমেরিকার জন্যও ভালো; কারণ অতিরিক্ত এই অর্থের অনেকটাই এখানে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যয় করা হবে।" প্রতিরক্ষা ব্যয়ের একটি বড় অংশ দিয়ে ইউরোপের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কিনবে, একথার মাধ্যমে তিনি সেটিই স্পষ্ট করেছেন।
পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার সীমান্তের ভেতরে ইউক্রেনকে হামলা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায়, ইউক্রেনের সীমান্তে ট্যাক্টিক্যাল (যুদ্ধে প্রয়োগযোগ্য বা সীমিত ধ্বংসক্ষমতার) পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া চালাচ্ছে রাশিয়া। এর আগে রোববার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফকে স্টলটেনবার্গ বলেছিলেন, চীন ও রাশিয়ার বর্ধিত হুমকি মোকাবিলায়– ন্যাটোও মোতায়েনযোগ্য পারমাণবিক ওয়ারহেড নিয়ে ভাবতে পারে।
ওয়াশিংটনে এসে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ওই মন্তব্যের বিষয়েও খোলাসা করেছেন ন্যাটো মহাসচিব। তিনি বলেন, আমার সরল বার্তাটি ছিল, ন্যাটো একটি পারমাণবিক জোট। তাই যেকোনো ন্যাটো সদস্যের ওপর আক্রমণ হলে– পুরো জোটের পক্ষ থেকে পাল্টা-আঘাত করা হবে।
তিনি বলেন, "ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধ লড়া নয়, বরং ঠেকানো।"
অনুবাদ: নূর মাজিদ