৫০ হাজার বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় পৃথিবীর প্রথম চিত্রকর্মটি আঁকা হয়েছিল: নেচার জার্নাল
এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম চিত্রকর্মের সন্ধান পাওয়া গেছে এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। দেশটির সুলাওয়েসি দ্বীপের একটি গুহায় ৫১ হাজার ২০০ বছর আগে আঁকা হয়েছিল চিত্রকর্মটি। এতে দেখা যায়, মানুষসদৃশ কয়েকটি আকৃতি একটি বন্য শূকর শিকার করছে।
গত বুধবার নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল এই চিত্রকর্মটি আবিষ্কার করেছিল।
এর ফলে বোঝা যায় এতদিন যা ধারণা করা হতো, তারও বহু আগেই মানুষ নিজেদের এবং প্রাণীর চিত্রকর্ম এঁকেছে।
প্রাগৈতিহাসিক শিলা শিল্পের মাধ্যমে আমরা প্রাথমিক মানব সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছি। তবে এসবের ওপর নির্ভর করে সময়কাল নিশ্চিত করা একটি কঠিন কাজ।
২০১৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক ম্যাক্সিম অবার্ট এবং তার সহকর্মীরা ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের এক স্থানে প্রাচীনতম ফিগারেটিভ পেইন্টিং বা রূপক চিত্রকর্মটি খুঁজে পান। সেসময় তারা ধারণা করেন বর্শার আঘাতে একটি প্রাণীকে বিদ্ধ করার এই চিত্রকর্মটি ৪০ হাজার বছর আগের।
এর কয়েক মাস পরে ২০১৯ সালে সুলাওসি দ্বীপে আরেকটি পুরনো চিত্রকর্ম আবিষ্কৃত হয়েছিল। এটি ছিল: দুটি বন্য শূকর, চারটি বামন মহিষ এবং আটটি মানুষসদৃশ প্রাণীর চিত্রকর্ম। এটি ৪ হাজার বছর পুরনো বলে অনুমান করা হয়েছিল।
তবে সম্প্রতি এই আবিষ্কারক দলটি লেজার-অ্যাবলেশন ইউ-সিরিজ ইমেজিং ব্যবহার করে আরও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা জানতে সক্ষম হয়েছেন। এই কৌশল ব্যবহার করে গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, চিত্রকর্মগুলো তাদের ধারণার চেয়েও আরও অনেক পুরনো।
সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৯ সালে সুলাওয়েসি দ্বীপে আবিষ্কৃত চিত্রকর্মটি কমপক্ষে ৪৮ হাজার বছরের পুরনো। যার অর্থ বিজ্ঞানীদের আগের ধারণার চেয়ে কমপক্ষে ৫ হাজার ৭০০ বছর আগেই রূপক চিত্রকর্ম আঁকা শুরু হয়েছিল।
আর ২০১৮ সালে উদ্ধার হওয়া চিত্রকর্মটির বয়স আরও বেশি।
অবার্ট বলেছেন, 'প্রথমবারের মতো আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ৫০ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো রক আর্ট খুঁজে পেয়েছি।'
মানুষের গল্প বলার ক্ষমতা
এটি সম্ভবত মানুষের ছবি দিয়ে বলা প্রাচীনতম গল্প। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এসব শিল্পীরা ছিলেন হোমো স্যাপিয়েন্স। এরা আমাদের নিজস্ব প্রজাতি, যারা এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোতে এসে পৌঁছেছিল।
অবার্টের মতে, চিত্রকর্মটি মোটেই সরল নয়, বরং 'বেশ উন্নত'।
তিনি বলেন, 'এটি সেই সময়ের মানুষের মানসিক সক্ষমতার পরিচয় দেয়।'
গল্প বলার ক্ষমতা এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত। এর প্রাচীনতম প্রমাণ হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় আবিষ্কৃত ১ লাখ বছর আগের খোদাই করা ওচার নোডুলস। পরবর্তী প্রমাণ হলো বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ আবিষ্কার, ৫০ হাজার বছর আগের গুহাচিত্র।
অবার্ট বলেছেন, 'আমরা বর্তমানে যা জানি তার চেয়ে পুরনো কিছু নেই বলেই ধারণা করছি '
যদিও তিনি ভবিষ্যতে আরও প্রাচীন কিছু আবিষ্কার করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
তিনি বলেন, 'হয়তো ভবিষ্যতে আমরা প্রাচীনতম রক আর্ট খুঁজে পাব।'
ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম চিত্রকর্মটি আবিষ্কারের সাথে সাথে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, রূপক শিল্পের জন্ম ইউরোপে না। তবে পরবর্তীকালে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে কমবেশি একইভাবে গুহা শিল্প উন্নত ও বিকশিত হয়েছিল।
ইউরোপে প্রাণীর প্রাচীনতম চিত্রকর্ম পাওয়া যায় ফ্রান্সের চৌভেট গুহায়। এটি ৩০ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো।
স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিহিস্টোরি বিভাগের অধ্যাপক দিয়েগো গ্যারাটে সহস্রাব্দ বছর ধরে মানুষের শিকারের দৃশ্য আঁকা এবং এক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে একই ধরনের চিত্রাবলী ব্যবহারের বিষয়টিকে 'অদ্ভুত' বলে অভিহিত করেন।
তিনি বলেন, প্রশ্ন হলো এশিয়া ও ইউরোপের অধিবাসীরা নিজেরাই প্রতীকী শিল্প আবিষ্কার করেছিল কি না, নাকি আফ্রিকা থেকে পৃথিবী জয় করা মানুষেরা তার আগেই ছবির সাহায্যে গল্প বলা শুরু করেছিলেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাওয়া ইন্দোনেশীয় চিত্রকর্মগুলো সম্পর্কে গ্যারাটে বলেন, 'এটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। আমরা এখন ইউরোসেন্ট্রিজমের বাইরের অন্যান্য সম্ভাবনা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করছি।'
তিনি বলেন, 'এটি কোনটি প্রাচীনতম তা নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা নয়। লক্ষ্য হলো এই কাজগুলো যারা করেছিল, তাদের সম্পর্কে জানা, যেহেতু আমরা তাদের সম্পর্কে খুব বেশি জানি না।'
অবার্ট ব্যাখ্যা করেন, শিল্পকর্মের বয়স নির্ধারণের জন্য নতুন কৌশলকে লেজার-অ্যাবলেশন ইউ-সিরিজ ইমেজিং বলা হয়। এই পদ্ধতিতে একটি লেজার ব্যবহার করে ক্ষুদ্র বিবরণের সাহায্যে নমুনা বিশ্লেষণ এবং আরও ভালোভাবে সময়কাল জানা যায়।
তিনি বলেন, 'সংক্ষেপে বললে এটি আরও সুনির্দিষ্ট এবং আরও দক্ষভাবে সময়কাল নির্ণয় করতে পারে।'
রক আর্টের সময়কাল নির্ণয়ে এই পদ্ধতিটি একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। ভবিষ্যতে এর ব্যবহার আরও বাড়তে পারে। কারণ এর জন্য অনেক ক্ষুদ্র নমুনার প্রয়োজন হয় এবং এতে শিল্পকর্মগুলোর নষ্ট হওয়ার হার কমেছে।
এই পদ্ধতিটি অন্যান্য চিত্রকর্মগুলোতেও প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং সম্ভবত বেলেপাথর বা অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর হতে পারে।
জ্ঞান যত অগ্রসর হয়, মানুষের উৎপত্তি এবং তাদের শৈল্পিক প্রকাশ তত বেশি রহস্যময় হয়ে ওঠে। কারণ যে কোনো মুহুর্তে একটি নতুন আবিষ্কার পূর্ববর্তী সমস্ত তত্ত্বকে ভেঙে দিতে পারে।
এই কারণে অবার্ট প্রাগৈতিহাসিক ঐশ্বর্য অন্বেষণ এবং সংরক্ষণ চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন 'মানুষ সম্ভবত ৫১ হাজার ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গল্প বলে আসছে।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি