বিশ্ব নেতা ও তাদের সঙ্গীদের পোশাকের দাম দেয় কারা?
বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের সঙ্গীদের জন্য ফ্যাশন শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়। বরং তা ক্ষমতা, প্রতিনিধিত্ব এবং প্রতীকবাদের অংশ। তবে এই পোশাক এবং ফ্যাশনের পেছনে যে-সব উপকরণ থাকে, সেগুলো মাঝে মাঝে বিতর্কের সৃষ্টি করে। এসব ক্ষেত্রে অনুদান, ব্যক্তিগত খরচ এবং সরকারি তহবিলের ব্যবহারের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা সবসময় সহজ হয় না। তাই এসব নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ ও পররাষ্ট্র বিষয়কমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার ও তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া যুক্তরাজ্যকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে নিজেদেরকে সেরা দেখানোর জন্য পোশাকের জন্য অনুদান গ্রহণ করেছেন।
কারা এসব অনুদান দেন, এ প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন দেশের সর্বোচ্চ করদাতাদের দিকেই ইঙ্গিত করছেন এ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সম্প্রতি ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার এবং তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া স্টারমারের বিরুদ্ধে পোশাকের অনুদান গ্রহণের বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। লেবার পার্টির দাতা লর্ড ওয়াহিদ আলির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর জন্য কেনা পোশাক সংসদীয় নিয়ম ভঙ্গ করে ঘোষণা না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিবিসিকে ল্যামি এ প্রসঙ্গেই জানাচ্ছিলেন।
বিবিসি আয়োজিত 'সানডে উইথ লরা কুইন্সবার্গ' প্রোগামে ল্যামি বলেন, "আমেরিকান জনগণের কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডিদের সেরা দেখাতে বড় বড় করদাতাদের অর্থে তাদের জন্য বিশাল বাজেট থাকে।"
তবে সরকারিভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পোশাকের জন্য বরাদ্দ থাকলেও ফার্স্ট লেডির জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। আর এ নীতি নিয়ে অনেকেই তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টদের জন্য থাকলেও, ভাতা নেই ফার্স্টে লেডির
বেশ কয়েকটি দেশে নেতাদের জীবনযাপনের খরচ আসে করদাতাদের কাছ থেকে। এ খরচের মধ্যে পোশাকও অন্তর্ভুক্ত।
মার্কিন প্রেসিডেন্টরা বার্ষিক চার লাখ ডলার বেতনের বাইরে আরো ৫০ হাজার ডলার পেয়ে থাকেন পোশাক ও যাবতীয় খরচের জন্য।
তবে ফার্স্ট লেডি এমন কোনো নির্দিষ্ট বেতন বা খরচ কিছুই পান না। যদিও তার জন্য বেতনভুক্ত কর্মী নিযুক্ত আছে এবং তার জন্য একটি কার্যালয়ও বরাদ্দ আছে। ফার্স্ট লেডি ফ্যাশন আইকন হিসেবে অনেকের মনোযোগ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন।
এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে মেলানিয়া ট্রাম্পের 'আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার, ডু ইউ?' লেখা জারা ব্র্যান্ডের জ্যাকেট। তিনি পোশাকটি একটি অভিবাসী কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় পরেছিলেন। অপরদিকে মিশেল ওবামার আলেকজান্ডার ম্যাককুইন ব্র্যান্ডের উজ্জ্বল লাল রঙের পোশাকটিও নজর কেড়েছিল অনেকের। তিনি সেটি চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পরেছিলেন।
বেশ কয়েকজন ফার্স্ট লেডি জানিয়েছেন, তাদের নিজেদের পোশাকের খরচ নিজেকেই বহন করতে হতো।
জর্জ ডব্লিউ বুশের স্ত্রী লরা বুশ তার ২০১০ সালের স্মৃতিকথায় লিখেছেন, "ফার্স্ট লেডি হিসেবে ফ্যাশনের মান বজায় রাখার জন্য আমাকে যে-সব ডিজাইনার পোশাক কিনতে হতো, তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।"
তিনি আরও লিখেছেন, "হোয়াইট হাউজে আমাদের প্রথম বছরের শেষে আমাদের হিসাবরক্ষক জর্জকে বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট হওয়াটা অনেক খরচের ব্যাপার। আর তিনি মূলত আমার পোশাকের খরচের কথাই বলছিলেন।"
মিশেল ওবামার প্রেস সেক্রেটারি জোয়ানা রশহল ২০১৪ সালে সিএনবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "মিসেস ওবামা তার নিজের পোশাকের জন্য নিজেই অর্থ ব্যয় করতেন "
মার্কিন ফার্স্ট লেডিরা প্রায়ই সরকারের পক্ষে উপহার হিসেবে পোশাক গ্রহণ করতে পারেন। কিছু কিছু ডিজাইনার আছেন যারা তাদের প্রচারের জন্য ফার্স্ট লেডিদের পোশাক দেওয়াকে স্বাগত জানান। কারণ এতে পোশাকগুলোর দাম সহজেই কয়েক হাজার ডলারে পৌঁছে যায়। ফলে হোয়াইট হাউসের তুলনামূলক কম সম্পদশালী বাসিন্দাদের জন্য এসব অনুদানই পোশাক পরার একমাত্র উপায়।
জোয়ানা রশহল বলেন, "যে কোনো সরকারি বা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন প্রোগামে যেমন- রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ফার্স্ট লেডি ডিজাইনারের উপহার হিসেবে এবং মার্কিন সরকারের পক্ষে পোশাক গ্রহণ করতে পারেন।"
স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম জানিয়েছে, বর্তমান ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন ২০২১ সালে তার স্বামীর অভিষেক অনুষ্ঠানে যে পোশাকটি পরেছিলেন, তা ডিজাইনার আলেকজান্দ্রিয়া ও'নিল 'ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনকে সম্মান জানিয়ে' দিয়েছিলেন। মূলত ডিজাইনার তাকে পোশাকটি ধার দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে, তার পূর্বসূরি মেলানিয়া ট্রাম্প ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্য নিজের পোশাক নিজেই কিনেছিলেন। পোশাকটি ডিজাইন করেছিলেন হার্ভে পিয়েরে।
যুক্তরাজ্যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের স্ত্রী সারা ব্রাউন ডাউনিং স্ট্রিটে থাকার সময় উপহার গ্রহণের বিশেষ করে পোশাক গ্রহণের সমস্যার কথা বলেছিলেন।
২০১১ সালে প্রকাশিত তার লেখা বই 'বিহাইন্ড দ্য ব্ল্যাক ডোর'-এ লিখেছেন, "আমি দ্রুতই বুঝতে পারলাম, অনেক ডিজাইনার ও খুচরা বিক্রেতা আছেন, যারা আপনাকে বিনামূল্যে পোশাক দিতে প্রস্তুত।"
তবে, পার্লামেন্ট সদস্যরা ও তার সঙ্গীরা বিনামূল্যে এসব উপহার কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করার অনেক নিয়ম রয়েছে। এছাড়া ক্ষমতা ব্যবহার করে বিনামূল্যে জিনিস নেওয়ার নৈতিক দিকও রয়েছে।
সারা ব্রাউন এ সমস্যার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, "১০ নং উপদেষ্টা ও আমি মিলে এমন একটি উপায় বের করেছিলাম, যা সবার জন্য কাজে দিয়েছিল। যে কোনো পোশাক আমি রাখতে চাইলে, আমি কিনতে পারি। আবার বিনামূল্যে দেওয়া পোশাক বা গয়না, আমি খুচরা মূল্যের প্রায় ১০ শতাংশ দিয়ে 'ভাড়াও' নিতে পারি এবং পরে তা ফেরত দিতে পারি।"
অন্যান্য দেশে নেতারা কী করেন?
যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন নিয়মের প্রচলন থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গীরা সাধারণত তাদের ফ্যাশন পছন্দের জন্য অনুদারের ওপরই নির্ভর করে থাকেন বলে মনে করা হয়।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গী ব্রিজিট ম্যাক্রোঁর জন্য পোশাকের কোনো সরকারি বাজেট নেই। তাই ধারণা করা হয় তিনি লুই ভিটনের মতো প্যারিসের নামি ফ্যাশন হাউস থেকে পোশাক ধার নেন।
২০১৯ সালে প্রকাশিত বই "ম্যাডাম লা প্রেসিডেন্ট"-এ বলা হয়েছে, তার কার্যালয় তাকে কোন পোশাকগুলো অনুদানের এবং কোনগুলো তার নিজের সেগুলোর রেকর্ড রাখে। তবে তার সঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নিজের অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য সমালোচিত হয়েছেন।
এই বছর একটি সংবাদপত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিজিটের কার্যালয় প্যারিস থেকে ব্রাজিল যাওয়ার একটি ফ্লাইটে শুধু তার দুটি স্যুট পরিবহনের জন্য প্রায় ৪,০০০ ইউরো (৩,৩৮০ পাউন্ড) খরচ করে একটি বিজনেস ক্লাস আসন সংরক্ষণ করেছিল।
২০২৩ সালের জার্মানিতে প্রথম ছয় মাসে মন্ত্রীরা হেয়ারড্রেসার, মেকআপ আর্টিস্ট এবং ফটোগ্রাফারের জন্য ৪৫০,০০০ ইউরো ব্যয় করার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। যদিও সেখানে পোশাকের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তহবিল নেই বলে মনে হয়।
ডেভিড ল্যামির মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে, পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ডাউনিং স্ট্রিট যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের পোশাকের অনুদান সম্পর্কে জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আরো জানায়, তারা বিশ্বাস করে যে তারা অনুগত ছিলেন। এ মাসে আরও তদন্তের পর তারা আরও কিছু বিষয়ের ঘোষণা দিবেন।